বিষয়: আমাদের পৃথিবী
অধ্যায় ১: পৃথিবীর অন্দরমহল (নোটস)
১. পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কত?
পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় ৬৩৭০ কিমি। অর্থাৎ, ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্ব ৬৩৭০ কিমি।
২. ভূ-অভ্যন্তরে তাপমাত্রা কেমনভাবে বাড়ে?
সাধারণভাবে প্রতি ৩৩ মিটার গভীরতায় প্রায় ১° সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বাড়ে।
৩. পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা কত?
পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৫° সেলসিয়াস।
৪. পৃথিবীর গভীরতম খনি ও কৃত্রিম গর্ত কোনটি?
- গভীরতম খনি: দক্ষিণ আফ্রিকার রবিনসন ডীপ সোনার খনি (গভীরতা ৩-৪ কিমি)।
- গভীরতম কৃত্রিম গর্ত: রাশিয়ার কোলা উপদ্বীপের গর্ত (গভীরতা ১২ কিমি)।
৫. ম্যাগমা (Magma) ও লাভা (Lava) কী?
ম্যাগমা: ভূ-গর্ভের পদার্থ প্রচণ্ড চাপ ও তাপে গ্যাস, বাষ্প মিশ্রিত হয়ে গলিত অবস্থায় থাকলে তাকে ম্যাগমা বলে।
লাভা: ভূ-গর্ভের গলিত উত্তপ্ত অর্ধতরল ম্যাগমা ফাটল দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের বাইরে বেরিয়ে এলে তাকে লাভা বলে।
চিত্র: ম্যাগমা ও লাভা। ম্যাগমা ভূ-অভ্যন্তরে থাকে, আর লাভা বাইরে বেরিয়ে আসে।
৬. উষ্ণ প্রস্রবণ (Hot Spring) কী?
যখন পৃথিবীর ভেতরকার জল (ভৌমজল) ভূ-তাপের সংস্পর্শে এসে গরম হয়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠের কোনো ফাটল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, তাকে উষ্ণ প্রস্রবণ বলে (যেমন – বক্রেশ্বর)।
চিত্র: উষ্ণ প্রস্রবণ। ভূ-তাপের প্রভাবে জল গরম হয়ে ওপরে উঠে আসে।
৭. ভূ-তাপ (Geothermal Energy) কী?
ভূ-তাপ হলো একধরনের শক্তি। পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপ ধীরে ধীরে বাইরের দিকে অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠের দিকে আসতে থাকে। এই তাপশক্তিকে ভূ-তাপ শক্তি বলে। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।
৮. ভূ-তাপ শক্তি উৎপাদনে কোন দেশ প্রথম?
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূ-তাপ শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। (আইসল্যান্ড চাহিদার প্রায় ৩০% ভূ-তাপ শক্তি দ্বারা মেটায়)।
৯. ঘনত্ব (Density) কী?
একক আয়তনে পদার্থের কতটুকু ভর আছে তার পরিমাপকে পদার্থের ঘনত্ব বলে। (প্রতি ঘন সেমি জায়গায় পদার্থের ভর)।
১০. পৃথিবীর পদার্থের ঘনত্ব কেমন? (সংক্ষিপ্ত উত্তর)
- ভূপৃষ্ঠের গড় ঘনত্ব: ২.৬ থেকে ৩.৩ গ্রাম/ঘন সেমি।
- পৃথিবীর কেন্দ্রের কাছে ঘনত্ব: প্রায় ১১ গ্রাম/ঘন সেমি (কেন্দ্রে ১৩-১৪ গ্রাম/ঘন সেমি)।
- পৃথিবীর গড় ঘনত্ব: ৫.৫ গ্রাম/ঘন সেমি।
ভারী পদার্থ (লোহা, নিকেল) কেন্দ্রের দিকে থিতিয়ে পড়েছে এবং হালকা পদার্থ (সিলিকা, অ্যালুমিনিয়াম) ওপরে ভেসে উঠেছে।
১১. ভূমিকম্প তরঙ্গ কীভাবে অন্দরমহল সম্পর্কে তথ্য দেয়?
ভূমিকম্পের তরঙ্গ বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়।
- P তরঙ্গ (Primary): কঠিন, তরল, গ্যাসীয়—সব মাধ্যমের মধ্যে দিয়েই যেতে পারে।
- S তরঙ্গ (Secondary): তরল বা অর্ধতরল মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে না।
S-তরঙ্গ পৃথিবীর তরল বহিঃকেন্দ্রমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে না, যা বিজ্ঞানীদের এই স্তরটি শনাক্ত করতে সাহায্য করেছে। এই তরঙ্গের গতিবিধি বিশ্লেষণ করেই বিজ্ঞানীরা ভেতরের স্তরবিন্যাস বুঝতে পারেন।
চিত্র: P ও S তরঙ্গ। P-তরঙ্গ সব মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যায়, কিন্তু S-তরঙ্গ তরল বহিঃকেন্দ্রমণ্ডলে বাধা পায়।
১২. পৃথিবীর প্রধান তিনটি স্তরের নাম লেখো।
পৃথিবীর অভ্যন্তরকে প্রধানত তিনটি স্তরে ভাগ করা যায় (পেঁয়াজের খোসার মতো):
- ভূত্বক (Crust): সবচেয়ে ওপরে।
- গুরুমণ্ডল (Mantle): মাঝের স্তর।
- কেন্দ্রমণ্ডল (Core): একেবারে কেন্দ্রে।
চিত্র: পৃথিবীর অভ্যন্তর (স্তরবিন্যাস)। এটি একটি সেদ্ধ ডিম বা পেঁয়াজের মতো স্তরযুক্ত।
২৬. পৃথিবীর প্রধান তিনটি স্তর সম্পর্কে সচিত্র আলোচনা করো।
পৃথিবীর অভ্যন্তরকে প্রধানত তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়:
- ভূত্বক (Crust): পৃথিবীর সবচেয়ে উপরের স্তর (গড় ৩০ কিমি পুরু)। এটি মহাদেশের নীচে হালকা গ্রানাইট (সিয়াল) এবং মহাসাগরের নীচে ভারী ব্যাসল্ট (সিমা) শিলা দিয়ে তৈরি।
- গুরুমণ্ডল (Mantle): ভূত্বকের নিচ থেকে প্রায় ২৯০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তর লোহা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম দিয়ে গঠিত। এর উপরের অংশে অর্ধ-তরল ‘অ্যাসথেনোস্ফিয়ার’ রয়েছে, যেখানে পরিচলন স্রোত দেখা যায়।
- কেন্দ্রমণ্ডল (Core): পৃথিবীর কেন্দ্রকে বেষ্টন করে থাকা স্তর (২৯০০ কিমি থেকে ৬৩৭০ কিমি)। এটি ভারী খনিজ নিকেল (Ni) ও লোহা (Fe) দিয়ে গঠিত, তাই একে ‘নিফে’ (Nife) বলে। এর দুটি ভাগ: তরল বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল ও কঠিন অন্তঃকেন্দ্রমণ্ডল।
চিত্র: পৃথিবীর প্রধান তিনটি স্তর।
১৩. ভূত্বকের গড় গভীরতা কত?
ভূত্বকের গড় গভীরতা প্রায় ৩০ কিমি। (মহাসাগরের নীচে ৫ কিমি, মহাদেশের নীচে ৬০ কিমি)।
১৪. ভূত্বকের প্রধান উপাদান কী?
ভূত্বকের প্রধান উপাদান হলো অক্সিজেন (প্রায় ৪৭%)। দ্বিতীয় প্রধান উপাদান সিলিকন।
১৫. সিয়াল (SIAL) ও সিমার (SIMA) মধ্যে পার্থক্য লেখো।
- সিয়াল (SIAL): মহাদেশীয় ভূত্বক, যা প্রধানত সিলিকন (Si) ও অ্যালুমিনিয়াম (Al) দিয়ে গঠিত। এটি গ্রানাইট জাতীয় শিলা দিয়ে তৈরি ও তুলনামূলক হালকা।
- সিমা (SIMA): মহাসাগরীয় ভূত্বক, যা প্রধানত সিলিকন (Si) ও ম্যাগনেশিয়াম (Mg) দিয়ে গঠিত। এটি ব্যাসল্ট জাতীয় শিলা দিয়ে তৈরি ও তুলনামূলক ভারী। সিয়াল সিমার উপরে ভাসমান।
চিত্র: সিয়াল ও সিমা। হালকা মহাদেশীয় পাত (সিয়াল) ভারী মহাসাগরীয় পাতের (সিমা) উপর ভাসমান।
১৬. ‘বিযুক্তি রেখা’ (Discontinuity) কাকে বলে? প্রধান বিযুক্তি রেখাগুলির নাম লেখো।
ভূ-অভ্যন্তরের বিভিন্ন ঘনত্বের স্তরগুলিকে যে কাল্পনিক রেখা দ্বারা আলাদা করা হয়, তাকে বিযুক্তি রেখা বলে। যেমন:
- কনরাড বিযুক্তি: সিয়াল ও সিমার মাঝে।
- মোহোরোভিসিক (মোহো) বিযুক্তি: ভূত্বক ও গুরুমণ্ডলের মাঝে।
- রেপিত্তি বিযুক্তি: ক্রোফেসিমা ও নিফেসিমার মাঝে।
- গুটেনবার্গ বিযুক্তি: গুরুমণ্ডল ও কেন্দ্রমণ্ডলের মাঝে।
- লেহম্যান বিযুক্তি: অন্তঃকেন্দ্রমণ্ডল ও বহিঃকেন্দ্রমণ্ডলের মাঝে।
১৭. শিলামণ্ডল (Lithosphere) কী?
ভূত্বক ও গুরুমণ্ডলের উপরিঅংশ নিয়ে গঠিত স্তরটি হলো শিলামণ্ডল। এর গভীরতা প্রায় ১০০ কিমি।
১৮. অ্যাসথেনোস্ফিয়ার (Asthenosphere) কী?
শিলামণ্ডলের নিচে গুরুমণ্ডলের ওপরের অংশে একটি বিশেষ দুর্বল, অর্ধ-তরল (সান্দ্র) স্তর হলো অ্যাসথেনোস্ফিয়ার। ‘Asthenosphere’ একটি গ্রিক শব্দ, যার মানে ‘দুর্বল স্তর’।
১৯. পরিচলন স্রোত (Convection Current) কাকে বলে ও এটি কোথায় দেখা যায়?
অ্যাসথেনোস্ফিয়ারে। ভূগর্ভের তাপে পদার্থগুলি উত্তপ্ত হয়ে ওপরে উঠে এসে অনুভূমিকভাবে প্রবাহিত হয় এবং ঠান্ডা হয়ে আবার নিচে নেমে যায়। এই চক্রাকার স্রোতকে পরিচলন স্রোত বলে। এই স্রোতের ফলেই উপরের শিলামণ্ডলের পাতগুলি সঞ্চালন করে।
চিত্র: অ্যাসথেনোস্ফিয়ারে পরিচলন স্রোত। এই স্রোতই উপরের শিলামণ্ডলের পাতগুলিকে সরায়।
২০. গুরুমণ্ডল (Mantle) বলতে কী বোঝো?
গুরুমণ্ডল ভূত্বকের নিচ থেকে প্রায় ২৯০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এর প্রধান উপাদান লোহা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও সিলিকন।
২১. গুরুমণ্ডলের দুটি উপস্তর কী কী? (ক্রোফেসিমা ও নিফেসিমা)
- ক্রোফেসিমা (CroFeSiMa): ওপরের অংশ (ক্রোমিয়াম, লোহা, সিলিকন, ম্যাগনেশিয়াম)।
- নিফেসিমা (NiFeSiMa): নিচের অংশ (নিকেল, লোহা, সিলিকন, ম্যাগনেশিয়াম)।
২২. কেন্দ্রমণ্ডলকে ‘নিফে’ (Nife) বলে কেন?
কেন্দ্রমণ্ডল অত্যন্ত ভারী খনিজ নিকেল (Ni) আর লোহা (Fe) দিয়ে তৈরি বলে একে ‘নিফে’ (Nife) বলে।
২৩. কেন্দ্রমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা কত?
কেন্দ্রমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা প্রায় ৫০০০° সেলসিয়াস।
২৪. কেন্দ্রমণ্ডলের দুটি উপস্তরের বর্ণনা দাও। (অন্তঃ ও বহিঃ)
- বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল (Outer Core): এটি ২৯০০ কিমি থেকে ৫১০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি অর্ধকঠিন বা সান্দ্র অবস্থায় আছে।
- অন্তঃকেন্দ্রমণ্ডল (Inner Core): এটি ৫১০০ কিমি থেকে ৬৩৭০ কিমি (কেন্দ্র) পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রচণ্ড চাপের ফলে এটি কঠিন অবস্থায় আছে।
২৫. পৃথিবীর চৌম্বকত্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে?
বহিঃকেন্দ্রমণ্ডলে সান্দ্র অবস্থায় থাকা লোহা প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে ঘুরতে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যেখান থেকেই পৃথিবীর চৌম্বকত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
২৭. বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অন্দরমহল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন কীভাবে? (সচিত্র আলোচনা)
সরাসরি পৃথিবীর কেন্দ্রে যাওয়া অসম্ভব, তাই বিজ্ঞানীরা পরোক্ষ উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করেন:
- অগ্ন্যুৎপাত: আগ্নেয়গিরির লাভা বিশ্লেষণ করে ভেতরের পদার্থের উষ্ণতা ও প্রকৃতি জানা যায়।
- ঘনত্ব: পৃথিবীর গড় ঘনত্ব (৫.৫ গ্রাম/ঘন সেমি) ভূপৃষ্ঠের ঘনত্ব (২.৬-৩.৩ গ্রাম/ঘন সেমি) থেকে অনেক বেশি। এটি প্রমাণ করে যে কেন্দ্রের দিকে লোহা ও নিকেলের মতো ভারী পদার্থ রয়েছে।
- ভূমিকম্প তরঙ্গ (প্রধান উপায়): P-তরঙ্গ (কঠিন, তরল সব মাধ্যমে যায়) ও S-তরঙ্গ (শুধু কঠিনে যায়) – এই দুই তরঙ্গের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা তরল বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল ও কঠিন অন্তঃকেন্দ্রমণ্ডলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন।
- খনি ও কৃত্রিম গর্ত: পৃথিবীর গভীরতম খনি (৩-৪ কিমি) ও গর্ত (১২ কিমি) থেকে সরাসরি শিলার নমুনা ও উষ্ণতার বৃদ্ধি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
চিত্র: পৃথিবীর অন্দরমহলের তথ্য সংগ্রহের পরোক্ষ উপায়।