বিষয়: আমাদের পৃথিবী
অধ্যায় ৬: জলবায়ু অঞ্চল (নোটস)
১. জলবায়ু অঞ্চল (Climate Zone) কাকে বলে?
পৃথিবীর যে যে অঞ্চলে জলবায়ুর উপাদান, বিশেষত উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সমধর্মী হয়, সেই সব অঞ্চলকে একত্রে জলবায়ু অঞ্চল বলে। একটি জলবায়ু অঞ্চলে মৃত্তিকা, স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য প্রায় একই রকম হয়।
২. উচ্চতা বাড়লে জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদ পরিবর্তন হয় কেন?
সমুদ্র সমতল থেকে প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতায় প্রায় ৬.৫° সেলসিয়াস হারে উষ্ণতা কমে যায়। এই কারণে পার্বত্য অঞ্চলে উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তিত হয় (শীতলতর হয়) এবং সেই জলবায়ুর সাথে মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক উদ্ভিদও বদলে যায়। যেমন, উষ্ণ আর্দ্র চিরসবুজ অরণ্য থেকে পর্ণমোচী, তারপর সরলবর্গীয় এবং শেষে তুন্দ্রা উদ্ভিদ (ঘাস, গুল্ম) দেখা যায়।
চিত্র: উচ্চতা অনুসারে জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের পরিবর্তন।
ক) উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ু: নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল
৩. অবস্থান:
নিরক্ষরেখার উভয় পাশে ০° থেকে ১০° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে (আমাজন অববাহিকা, কঙ্গো অববাহিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া) এই জলবায়ু দেখা যায়।
৪. নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য কী?
- উষ্ণতা: সারাবছর সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়ায় উষ্ণতা খুব বেশি থাকে (গড় ২৭° সে.)। বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর (পার্থক্য) মাত্র ২°-৩° সে., যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন।
- বৃষ্টিপাত: সারাবছর প্রচুর পরিচলন বৃষ্টিপাত হয় (বার্ষিক ২০০-২৫০ সেমি)। প্রতিদিন বিকেলে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি হয়, একে ‘4 O’clock Rain’ বলে।
৫. নিরক্ষীয় অঞ্চলে ‘চিরসবুজ অরণ্য’ (Evergreen Forest) সৃষ্টি হয়েছে কেন?
সারাবছর অত্যধিক উষ্ণতা ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে এখানকার গাছপালার পাতা ঝরার নির্দিষ্ট কোনো ঋতু নেই। সব গাছে সারাবছর সবুজ পাতা থাকে, তাই একে ‘চিরসবুজ অরণ্য’ বলে।
৬. ‘সেলভা’ (Selva) কী?
ব্রাজিলের আমাজন নদী অববাহিকার চিরসবুজ অরণ্য ‘সেলভা’ নামে পরিচিত।
৭. নিরক্ষীয় অরণ্যের উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য কী?
- গাছগুলি খুব লম্বা, শক্ত ও ভারী হয়। পাতা বড় ও চওড়া হয়।
- গাছগুলি খুব কাছাকাছি জন্মায়, ফলে অরণ্যের উপরে একটি ঘন চাঁদোয়া বা ‘Canopy’ তৈরি হয়।
- সূর্যের আলো নীচে পৌঁছাতে পারে না বলে অরণ্যের তলদেশ স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার ও দুর্গম হয়। প্রধান গাছ: রবার, মেহগনি, রোজউড, আয়রন উড।
৮. নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের অধিবাসী ও জীবনযাত্রা কেমন?
অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু ও দুর্গম পরিবেশের কারণে এখানে জনবসতি খুব কম। আমাজন অববাহিকায় রেড ইন্ডিয়ান, কঙ্গো অববাহিকায় পিগমি, মালয়েশিয়ায় সেমাং প্রভৃতি উপজাতি বাস করে। তাদের প্রধান জীবিকা ফলমূল সংগ্রহ, পশুশিকার ও আদিম স্থানান্তর কৃষি। বর্তমানে বাগিচা কৃষি (রবার, কোকো, পাম) ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনের গুরুত্ব বাড়ছে।
খ) গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ু: মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চল
৯. অবস্থান:
উভয় গোলার্ধে ১০° থেকে ৩০° অক্ষাংশে মহাদেশের পূর্বে (ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এই জলবায়ু দেখা যায়।
১০. মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য কী?
- ঋতু পরিবর্তন: প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ঋতু পরিবর্তন এবং ঋতুভেদে বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ।
- গ্রীষ্মকাল: উষ্ণ ও আর্দ্র। সমুদ্র থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু’ প্রবাহিত হয় এবং প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়।
- শীতকাল: শীতল ও শুষ্ক। স্থলভাগ থেকে শুষ্ক ‘উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু’ প্রবাহিত হয়। (ব্যতিক্রম: করমণ্ডল উপকূল)।
১১. ‘মৌসুমি বিস্ফোরণ’ (Burst of Monsoon) কী?
বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে যে আকস্মিক ও প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়, তাকে ‘মৌসুমি বিস্ফোরণ’ বলে।
১২. পর্ণমোচী অরণ্য (Deciduous Forest) কাকে বলে?
মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে শীতকাল শুষ্ক থাকায় গাছেরা বাষ্পীভবন কমানোর জন্য বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে (শীতকালে বা বসন্তে) সব পাতা ঝরিয়ে দেয়। তাই এই অরণ্যকে ‘পর্ণমোচী’ (পাতা ঝরা) অরণ্য বলে। যেমন – শাল, সেগুন, শিমুল, পলাশ, আম, কাঁঠাল।
১৩. মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চল অত্যন্ত জনবহুল কেন?
অনুকূল জলবায়ু, উর্বর পলিমাটি, কৃষিকাজে জলের সুবিধা (বৃষ্টিপাত), উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কারণে এই অঞ্চল কৃষিকাজে খুব উন্নত। ধান, পাট, গম, আখ, তুলা প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। কৃষির উন্নতির ফলে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, তাই এই অঞ্চল পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
গ) নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু: ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল
১৪. অবস্থান:
উভয় গোলার্ধে ৩০° থেকে ৪০° অক্ষাংশে মহাদেশের পশ্চিমে (ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ, ক্যালিফোর্নিয়া, মধ্য চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে) এই জলবায়ু দেখা যায়।
১৫. ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য কী?
- শুষ্ক গ্রীষ্মকাল: গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চল আয়ন বায়ুর প্রভাবে থাকায় স্থলভাগ থেকে শুষ্ক বায়ু বয়, তাই বৃষ্টিপাত হয় না। আকাশ রোদ ঝলমলে থাকে।
- আর্দ্র শীতকাল: শীতকালে এই অঞ্চল পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে আসে। পশ্চিমা বায়ু সমুদ্রের উপর দিয়ে আসায় জলীয়বাষ্পপূর্ণ হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়।
- এটিই পৃথিবীর একমাত্র জলবায়ু অঞ্চল যেখানে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়।
১৬. ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে ‘ফলের ঝুড়ি’ (Basket of Fruits) বলা হয় কেন?
সারা বছর রোদ ঝলমলে আবহাওয়া এবং শীতকালীন বৃষ্টিপাতের কারণে এই অঞ্চলে প্রচুর রসালো ফলের চাষ হয়। আঙুর, জলপাই, কমলালেবু, আপেল, পিচ, আখরোট, ডুমুর ইত্যাদি ফল উৎপাদনে এই অঞ্চল বিখ্যাত, তাই একে ‘ফলের ঝুড়ি’ বলে।
ঘ) শীতল জলবায়ু: তুন্দ্রা জলবায়ু অঞ্চল
১৭. অবস্থান:
সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্তের নিকটবর্তী অঞ্চলে (ইউরেশিয়া ও উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশ, গ্রিনল্যান্ডের উপকূল) এই জলবায়ু দেখা যায়।
১৮. তুন্দ্রা জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য কী?
- দীর্ঘ ও হিমশীতল শীতকাল: বছরে ৮-৯ মাস শীতকাল। উষ্ণতা -২০° সে. থেকে -৪০° সে. পর্যন্ত নেমে যায়। একটানা অন্ধকার থাকে ও তুষারঝড় হয়।
- স্বল্পস্থায়ী গ্রীষ্মকাল: ২-৩ মাসের জন্য গ্রীষ্মকাল আসে। গড় উষ্ণতা থাকে প্রায় ১০° সে.। বরফ গলে যায়। এই সময় আকাশে সূর্য প্রায় ডোবে না (নিশীথ সূর্য)।
- বৃষ্টিপাত: বৃষ্টিপাত প্রায় হয় না বললেই চলে (বার্ষিক ২০-৩০ সেমি), যা হয় তা মূলত গ্রীষ্মকালেই।
১৯. ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ (Land of the Midnight Sun) কাকে বলে?
তুন্দ্রা জলবায়ু অঞ্চলে (যেমন – নরওয়ের হ্যামারফেস্ট) গ্রীষ্মকালে আকাশে সূর্য প্রায় অস্ত যায় না। গভীর রাতেও আকাশে সূর্য দেখা যায়, তাই এই অঞ্চলকে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ বলে।
২০. তুন্দ্রা অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ কী?
বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে বলে এখানে বড় গাছ জন্মায় না। গ্রীষ্মকালে বরফ গলে গেলে শৈবাল, মস, লাইকেন এবং ছোট ছোট গুল্ম ও ঘাস জন্মায়।
২১. ইগলু (Igloo), টিউপিক (Tupiq), কায়াক (Kayak) ও শ্লেজ (Sledge) কী?
তুন্দ্রা অঞ্চলের অধিবাসী এস্কিমোদের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত বিষয়:
- ইগলু: শীতকালে বরফের তৈরি গোলাকার ঘর।
- টিউপিক: গ্রীষ্মকালে সিল মাছের চামড়ায় তৈরি তাঁবু।
- কায়াক: সিল মাছের চামড়ায় তৈরি সরু নৌকা।
- শ্লেজ: বরফের উপর দিয়ে কুকুর বা বলগা হরিণে টানা চাকাবিহীন গাড়ি।
২২. চারটি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলের তুলনা করো।
| বিষয় | নিরক্ষীয় | মৌসুমি | ভূমধ্যসাগরীয় | তুন্দ্রা |
|---|---|---|---|---|
| জলবায়ু | উষ্ণ ও আর্দ্র (সারাবছর বৃষ্টি) | উষ্ণ আর্দ্র গ্রীষ্মকাল, শুষ্ক শীতকাল | শুষ্ক গ্রীষ্মকাল, আর্দ্র শীতকাল | হিমশীতল (গ্রীষ্মে সামান্য বৃষ্টি) |
| বৃষ্টির সময় | সারাবছর (প্রতিদিন বিকেলে) | প্রধানত গ্রীষ্মকালে | প্রধানত শীতকালে | প্রধানত গ্রীষ্মকালে (খুব কম) |
| স্বাভাবিক উদ্ভিদ | চিরসবুজ অরণ্য (সেলভা) | পর্ণমোচী অরণ্য (শাল, সেগুন) | চিরসবুজ গুল্ম (জলপাই, আঙুর) | শৈবাল, মস, লাইকেন (গাছ নেই) |
| অধিবাসী (উদাহরণ) | পিগমি, রেড ইন্ডিয়ান | (অত্যন্ত জনবহুল) | (বেশ জনবহুল) | এস্কিমো, ল্যাপ (জনবিরল) |
জলবায়ু লেখচিত্র (Climate Graphs)
নিচের লেখচিত্রগুলি বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলের বার্ষিক উষ্ণতা (রেখা) ও বৃষ্টিপাত (স্তম্ভ) দেখাচ্ছে।
চিত্র: নিরক্ষীয় জলবায়ু (পেরু)। উচ্চ উষ্ণতা ও সারাবছর প্রচুর বৃষ্টি।
চিত্র: ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু (এথেন্স)। শুষ্ক গ্রীষ্মকাল ও আর্দ্র শীতকাল (শীতকালীন বৃষ্টি)।
চিত্র: তুন্দ্রা জলবায়ু (র্যাঙ্কিন)। দীর্ঘ হিমশীতল শীতকাল, স্বল্পস্থায়ী গ্রীষ্ম, খুব কম বৃষ্টি।