বিষয়: আমাদের পৃথিবী
অধ্যায় ৪: চাপবলয় ও বায়ুপ্রবাহ (নোটস)
১. বায়ুচাপ বলয় (Pressure Belts) কাকে বলে?
পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর নির্দিষ্ট দূরত্বে সমধর্মী বায়ুস্তর অনুভূমিকভাবে হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে পৃথিবীকে কয়েকটি বলয়ের আকারে বেষ্টন করে আছে। একে বায়ুচাপ বলয় বলে।
২. পৃথিবীতে মোট কয়টি বায়ুচাপ বলয় আছে?
পৃথিবীতে মোট ৭টি বায়ুচাপ বলয় আছে। (৪টি উচ্চচাপ বলয় এবং ৩টি নিম্নচাপ বলয়)।
৩. নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় বা নিরক্ষীয় শান্তবলয় (Doldrums) কাকে বলে?
নিরক্ষরেখার উভয় পাশে ০° থেকে ৫° অক্ষরেখার মধ্যে অঞ্চলে সারাবছর সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়ায় এখানকার বায়ু উষ্ণ, হালকা ও জলীয়বাষ্পপূর্ণ হয়ে সোজা উপরে উঠে যায়। ফলে এখানে বায়ুর কোনো অনুভূমিক প্রবাহ (বায়ুপ্রবাহ) থাকে না, একটি শান্ত ভাব বিরাজ করে। তাই এই অঞ্চলকে ‘নিরক্ষীয় শান্তবলয়’ বা ‘ডোলড্রামস’ (Doldrums) বলে।
৪. কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় বা অশ্ব অক্ষাংশ (Horse Latitudes) কাকে বলে?
উভয় গোলার্ধে ২৫° থেকে ৩৫° অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে আসা শীতল ও ভারী বায়ু এবং মেরু অঞ্চল থেকে আসা শীতল বায়ু মিলিত হয়ে নীচে নামে। ফলে এখানে বায়ুর পরিমাণ ও ঘনত্ব বাড়ে এবং উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। এখানেও বায়ুপ্রবাহ শান্ত থাকে। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে জাহাজগুলি গতিহীন হয়ে পড়লে ভার কমানোর জন্য ঘোড়া (অশ্ব) সমুদ্রে ফেলা হতো, তাই এই অঞ্চলকে ‘অশ্ব অক্ষাংশ’ বলে।
৫. সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় কাকে বলে?
উভয় গোলার্ধে ৬০° থেকে ৭০° অক্ষরেখার মাঝে মেরু অঞ্চলের তুলনায় উষ্ণতা বেশি হওয়ায় বায়ু হালকা হয়ে উপরে ওঠে। এই ঊর্ধ্বগামী বায়ু পৃথিবীর আবর্তনের কারণে বিক্ষিপ্ত হয়ে ক্রান্তীয় ও মেরু অঞ্চলে নেমে যায়। ফলে এখানে বায়ুর পরিমাণ কমে নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়।
৬. সুমেরু ও কুমেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় কাকে বলে?
উভয় গোলার্ধে ৮০° অক্ষরেখা থেকে মেরুবিন্দু পর্যন্ত অঞ্চলে সারাবছর বরফে ঢাকা থাকায় উষ্ণতা হিমাঙ্কের নীচে থাকে। ফলে এখানকার বাতাস প্রচণ্ড শীতল, ভারী ও শুষ্ক। এই কারণে এখানে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
৭. পৃথিবীর প্রধান বায়ুচাপ বলয়গুলি সচিত্র বর্ণনা করো।
পৃথিবীর ৭টি চাপবলয়কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- তাপজনিত বলয় (Thermally induced): উষ্ণতার কারণে সরাসরি সৃষ্ট।
- নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় (১টি): অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে বায়ু হালকা হয়ে উপরে ওঠায় সৃষ্টি হয়।
- দুই মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় (২টি): অতিরিক্ত শীতলতার কারণে বায়ু ভারী হয়ে নীচে নামায় সৃষ্টি হয়।
- গতিজনিত বলয় (Dynamically induced): পৃথিবীর আবর্তনের ফলে বায়ুর গতিবিক্ষেপের কারণে সৃষ্ট।
- কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় (২টি): নিরক্ষীয় ও মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চল থেকে আসা বায়ু এখানে নীচে নামায় সৃষ্টি হয়।
- সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় (২টি): এখানকার বায়ু উপরে উঠে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়।
চিত্র: পৃথিবীর প্রধান ৭টি বায়ুচাপ বলয়।
৮. বায়ুপ্রবাহ (Wind) কী?
বায়ুচাপের সমতা রাখার জন্য বায়ু যখন উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে অনুভূমিকভাবে প্রবাহিত হয়, তাকে বায়ুপ্রবাহ বলে।
৯. কোরিওলিস বল (Coriolis force) কী?
পৃথিবীর আবর্তন গতির কারণে বায়ুর স্বাভাবিক প্রবাহের উপর একধরনের বল কাজ করে, যা বায়ুপ্রবাহের দিকবিক্ষেপ ঘটায়। এই বলকে কোরিওলিস বল বলে।
১০. ফেরেলের সূত্র (Ferrel’s Law) কী?
কোরিওলিস বলের কারণে বায়ুপ্রবাহ সোজাপথে না গিয়ে উত্তর গোলার্ধে তার প্রবাহের ডানদিকে বেঁকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে তার প্রবাহের বাঁদিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। এটিই ফেরেলের সূত্র।
চিত্র: ফেরেলের সূত্র অনুসারে বায়ুর দিকবিক্ষেপ।
১১. বাইস ব্যালট সূত্র (Buys Ballot’s Law) কী?
উত্তর গোলার্ধে বায়ু যেদিক থেকে প্রবাহিত হয় সেদিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালে ডানদিকে উচ্চচাপ ও বাঁদিকে নিম্নচাপ হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে এর ঠিক বিপরীত অবস্থা দেখা যায়।
১২. নিয়ত বায়ুপ্রবাহ (Planetary Winds) কাকে বলে?
সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে নির্দিষ্ট বায়ুচাপ বলয়গুলির মধ্যে প্রবাহিত বায়ুকে নিয়ত বায়ুপ্রবাহ বলে।
১৩. নিয়ত বায়ুপ্রবাহ কয় প্রকার ও কী কী?
নিয়ত বায়ুপ্রবাহ তিন প্রকার:
- আয়ন বায়ু (Trade Wind)
- পশ্চিমা বায়ু (Westerlies)
- মেরু বায়ু (Polar Wind)
১৪. আয়ন বায়ু (Trade Wind) কাকে বলে?
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় (২৫°-৩৫°) থেকে সারাবছর ধরে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের (০°-৫°) দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে আয়ন বায়ু বলে।
- উত্তর গোলার্ধে: ফেরেলের সূত্র অনুসারে ডানদিকে বেঁকে এটি ‘উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু’ রূপে বয়।
- দক্ষিণ গোলার্ধে: ফেরেলের সূত্র অনুসারে বাঁদিকে বেঁকে এটি ‘দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু’ রূপে বয়।
১৫. পশ্চিমা বায়ু (Westerlies) কাকে বলে?
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় (২৫°-৩৫°) থেকে সারাবছর ধরে সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের (৬০°-৭০°) দিকে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে পশ্চিমা বায়ু বলে।
- উত্তর গোলার্ধে: এটি ডানদিকে বেঁকে ‘দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু’ রূপে বয়।
- দক্ষিণ গোলার্ধে: এটি বাঁদিকে বেঁকে ‘উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু’ রূপে বয়।
১৬. মেরু বায়ু (Polar Wind) কাকে বলে?
সুমেরু ও কুমেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় (৮০°-৯০°) থেকে সারাবছর ধরে সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের (৬০°-৭০°) দিকে যে শীতল ও শুষ্ক বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে মেরু বায়ু বলে।
- উত্তর গোলার্ধে: এটি ডানদিকে বেঁকে ‘উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু’ রূপে বয়।
- দক্ষিণ গোলার্ধে: এটি বাঁদিকে বেঁকে ‘দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু’ রূপে বয়।
১৭. ‘গর্জনশীল চল্লিশা’, ‘ক্রোধোন্মত্ত পঞ্চাশ’, ‘তীক্ষ্ণ চিৎকারকারী ষাট’ কী?
দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি হওয়ায় পশ্চিমা বায়ু কোনো বাধা ছাড়াই প্রচণ্ড গতিতে ও সশব্দে প্রবাহিত হয়। এই কারণে:
- ৪০° দক্ষিণ অক্ষাংশে: একে গর্জনশীল চল্লিশা (Roaring Forties) বলে।
- ৫০° দক্ষিণ অক্ষাংশে: একে ক্রোধোন্মত্ত পঞ্চাশ (Howling Fifties) বলে।
- ৬০° দক্ষিণ অক্ষাংশে: একে তীক্ষ্ণ চিৎকারকারী ষাট (Screaming Sixties) বলে।
১৮. সাময়িক বায়ু (Periodic Wind) কাকে বলে?
বছরের একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে সাময়িক বায়ু বলে। যেমন – সমুদ্রবায়ু, স্থলবায়ু, মৌসুমি বায়ু।
১৯. সমুদ্রবায়ু ও স্থলবায়ু কাকে বলে?
- সমুদ্রবায়ু (Sea Breeze): দিনের বেলা স্থলভাগ জলভাগের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হলে স্থলভাগে নিম্নচাপ ও সমুদ্রে উচ্চচাপ তৈরি হয়। তখন সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে যে ঠান্ডা বাতাস বয়, তাকে সমুদ্রবায়ু বলে।
- স্থলবায়ু (Land Breeze): রাতের বেলা স্থলভাগ দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হলে স্থলভাগে উচ্চচাপ ও সমুদ্রে নিম্নচাপ তৈরি হয়। তখন স্থলভাগ থেকে সমুদ্রের দিকে যে বাতাস বয়, তাকে স্থলবায়ু বলে।
চিত্র: সমুদ্রবায়ু (দিনে) এবং স্থলবায়ু (রাতে)।
২০. মৌসুমি বায়ু (Monsoon Wind) কাকে বলে?
মৌসুমি বায়ু হলো একটি সাময়িক বায়ু, যা ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তার প্রবাহের দিক সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে পরিবর্তন করে।
- গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু: গ্রীষ্মকালে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু সমুদ্র (উচ্চচাপ) থেকে স্থলভাগের (নিম্নচাপ) দিকে প্রবাহিত হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়।
- শীতকালীন মৌসুমি বায়ু: শীতকালে শীতল ও শুষ্ক বায়ু স্থলভাগ (উচ্চচাপ) থেকে সমুদ্রের (নিম্নচাপ) দিকে প্রবাহিত হয়।
২১. অ্যানাবেটিক ও ক্যাটাবেটিক বায়ু কাকে বলে?
- অ্যানাবেটিক বায়ু (Anabatic): দিনের বেলা সূর্যের তাপে পর্বতের ঢালের বায়ু উত্তপ্ত ও হালকা হয়ে উপত্যকা থেকে পর্বতের ঢাল বরাবর উপরের দিকে উঠতে থাকে। এই ঊর্ধ্বগামী বায়ুকে উপত্যকা বায়ু বা অ্যানাবেটিক বায়ু বলে।
- ক্যাটাবেটিক বায়ু (Katabatic): রাতের বেলা পর্বতের ঢালের বায়ু দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল ও ভারী হয়ে ঢাল বরাবর নীচের দিকে উপত্যকায় নামতে থাকে। এই নিম্নগামী বায়ুকে পার্বত্য বায়ু বা ক্যাটাবেটিক বায়ু বলে।
২২. আকস্মিক বায়ু (Variable Wind) কাকে বলে?
স্বল্প পরিসর স্থানে হঠাৎ করে বায়ুচাপের তীব্র পার্থক্যের কারণে যে অনিয়মিত বায়ুপ্রবাহ দেখা যায়, তাকে আকস্মিক বায়ু বলে। যেমন – ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত।
২৩. ঘূর্ণবাত (Cyclone) ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত (Anticyclone) -এর পার্থক্য লেখো।
| বিষয় | ঘূর্ণবাত (Cyclone) | প্রতীপ ঘূর্ণবাত (Anticyclone) |
|---|---|---|
| চাপবিন্যাস | কেন্দ্রে গভীর নিম্নচাপ এবং বাইরে উচ্চচাপ থাকে। | কেন্দ্রে উচ্চচাপ এবং বাইরে নিম্নচাপ থাকে। |
| বায়ুপ্রবাহ | বায়ু বাইরে থেকে কেন্দ্রের দিকে কুণ্ডলী আকারে ছুটে আসে। | বায়ু কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে যায়। |
| উত্তর গোলার্ধে দিক | ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে (Anti-clockwise) বয়। | ঘড়ির কাঁটার দিকে (Clockwise) বয়। |
| আবহাওয়া | বিধ্বংসী প্রকৃতির। ঝড়, বৃষ্টি ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া তৈরি করে। | শান্ত, মেঘমুক্ত ও রোদ ঝলমলে আবহাওয়া নির্দেশ করে। |
চিত্র: ঘূর্ণবাত (বাম) ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত (ডান)।