বিষয়: আমাদের পৃথিবী
অধ্যায় ১১: ওশিয়ানিয়া (নোটস)
সাধারণ পরিচিতি
১. ওশিয়ানিয়া মহাদেশের অবস্থান ও সীমানা লেখো।
অবস্থান: ওশিয়ানিয়া হলো প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত কতগুলি দ্বীপের সমষ্টি। এটি সম্পূর্ণরূপে দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত।
সীমানা:
- উত্তরে: এশিয়া মহাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগর।
- পূর্বে: প্রশান্ত মহাসাগর।
- পশ্চিমে: ভারত মহাসাগর।
- দক্ষিণে: কুমেরু মহাসাগর।
২. ওশিয়ানিয়া মহাদেশকে ‘দ্বীপ মহাদেশ’ (Island Continent) বলা হয় কেন?
ওশিয়ানিয়া মহাদেশটি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ (মেলানেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়া, পলিনেশিয়া) নিয়ে গঠিত। এটি মূলত অসংখ্য দ্বীপের সমষ্টি, তাই একে ‘দ্বীপ মহাদেশ’ বলা হয়।
৩. ওশিয়ানিয়ার প্রধান দ্বীপপুঞ্জগুলির নাম কী?
ওশিয়ানিয়া মূলত চারটি প্রধান অঞ্চল নিয়ে গঠিত:
- অস্ট্রেলেশিয়া: (অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও তাসমানিয়া)
- মেলানেশিয়া: (নিউ গিনি, ফিজি, নিউ ক্যালিডোনিয়া)
- মাইক্রোনেশিয়া: (মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, গুয়াম, পালাউ)
- পলিনেশিয়া: (টোঙ্গা, সামোয়া, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ)
৪. অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহরের নাম কী?
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা এবং বৃহত্তম শহর সিডনি।
ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য (অস্ট্রেলিয়া)
৫. অস্ট্রেলিয়ার ভূপ্রাকৃতিক বিভাগগুলি কী কী?
অস্ট্রেলিয়ার ভূপ্রকৃতিকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল: এটি একটি প্রাচীন মালভূমি এবং মহাদেশের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে অবস্থিত। এটি মূলত মরুভূমি (গ্রেট ভিক্টোরিয়া, গিবসন)।
- পূর্বের উচ্চভূমি অঞ্চল: পূর্বে উপকূল বরাবর উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ‘গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জ’ পর্বতমালা অবস্থিত। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলো মাউন্ট কোসিয়াস্কো (২,২২৮ মি)।
- মধ্যভাগের সমভূমি অঞ্চল: পশ্চিমে মালভূমি ও পূর্বে উচ্চভূমির মাঝে এই সমভূমি অবস্থিত। এর দুটি অংশ – উত্তরের কার্পেন্টারিয়া সমভূমি এবং দক্ষিণের মারি-ডার্লিং অববাহিকা।
৬. গ্রেট বেরিয়ার রিফ (Great Barrier Reef) বা ‘মহান প্রবাল প্রাচীর’ কী?
অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের অদূরে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবাল বা কোরাল নামক একপ্রকার সামুদ্রিক কীটের দেহবশেষ জমে পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রবাল প্রাচীর (Reef) সৃষ্টি হয়েছে। একেই গ্রেট বেরিয়ার রিফ বলে। এটি প্রায় ২,৩০০ কিমি দীর্ঘ এবং এটি মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান।
চিত্র: অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে গ্রেট বেরিয়ার রিফের অবস্থান।
৭. মাউন্ট কোসিয়াস্কো (Mt. Kosciuszko) কী?
গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এবং অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের উচ্চতম স্থান হলো মাউন্ট কোসিয়াস্কো (২,২২৮ মি)।
৮. ‘আর্টেজীয় কূপ’ (Artesian Well) কী? এটি কোথায় দেখা যায়?
অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগের সমভূমির একটি বড় অংশ গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জ এবং পশ্চিমের মালভূমির মধ্যে অবস্থিত। এই অঞ্চলের মাটির গঠন অবতল (বাটির মতো)। মাটির নীচে দুটি অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্যে একটি প্রবেশ্য শিলাস্তর (জলপূর্ণ) থাকে। এই প্রবেশ্য স্তরে কূপ খনন করলে ভূগর্ভের জলের চাপে জল নিজে থেকেই ফোয়ারার মতো ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে। একে ‘আর্টেজীয় কূপ’ বলে। অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগের সমভূমিতে (বিশেষত কুইন্সল্যান্ডে) এটি দেখা যায়।
চিত্র: আর্টেজীয় কূপের গঠন।
নদনদী ও জলবায়ু
৯. অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নদীর নাম কী?
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নদী হলো মারি (Murray) এবং তার প্রধান উপনদী হলো ডার্লিং (Darling)। এই নদী অববাহিকা অস্ট্রেলিয়ার প্রধান কৃষি অঞ্চল।
১০. অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
- বিপরীতা ঋতু: অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধে হওয়ায় উত্তর গোলার্ধের ঠিক বিপরীত ঋতু দেখা যায়। যখন উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল, তখন অস্ট্রেলিয়ায় শীতকাল (জুন-আগস্ট)।
- মরু জলবায়ু: মহাদেশের মধ্য ও পশ্চিম ভাগের বিশাল অংশ জুড়ে মরু জলবায়ু (উষ্ণ ও শুষ্ক) বিরাজ করে।
- ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু: দক্ষিণ-পশ্চিম (পার্থ) ও দক্ষিণ-পূর্বে (অ্যাডিলেড) ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু (শীতকালে বৃষ্টি) দেখা যায়।
- মৌসুমি জলবায়ু: উত্তর উপকূলে মৌসুমি জলবায়ুর (গ্রীষ্মে বৃষ্টি) প্রভাব দেখা যায়।
১১. ‘ক্যান্টারবেরি সমভূমি’ (Canterbury Plains) কী?
নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপের পূর্ব দিকে অবস্থিত প্রধান সমভূমি অঞ্চল হলো ক্যান্টারবেরি সমভূমি। এটি নিউজিল্যান্ডের প্রধান কৃষি ও পশুপালন অঞ্চল।
অর্থনৈতিক পরিবেশ
১২. ডাউনস (Downs) তৃণভূমি কী?
অস্ট্রেলিয়ার মারি-ডার্লিং নদী অববাহিকায় অবস্থিত নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমিকে ‘ডাউনস’ বলা হয়। এটি পশুপালনের জন্য বিখ্যাত।
১৩. অস্ট্রেলিয়া পশুপালনে এত উন্নত কেন?
অস্ট্রেলিয়া পশুপালনে, বিশেষত মেরিনো ভেড়া পালনে পৃথিবীতে প্রথম। এর কারণ:
- বিস্তীর্ণ তৃণভূমি: পশুপালনের জন্য ডাউনস-এর মতো বিশাল নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি রয়েছে।
- জলবায়ু: পশুপালনের উপযোগী শুষ্ক ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বিদ্যমান।
- জলসেচ: আর্টেজীয় কূপের জল পশুপালনের জলের চাহিদা মেটায়।
- মেরিনো ভেড়া: এখানকার মেরিনো ভেড়া থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানের পশম (merino wool) পাওয়া যায়।
১৪. নিউজিল্যান্ড ডেয়ারি শিল্পে উন্নত কেন?
নিউজিল্যান্ড ডেয়ারি শিল্পে (দুধ, মাখন, পনির) পৃথিবীতে বিখ্যাত। এর কারণ:
- জলবায়ু: এখানকার শীতল ও আর্দ্র সামুদ্রিক জলবায়ু উন্নত মানের তৃণ জন্মানোর পক্ষে আদর্শ।
- তৃণভূমি: ক্যান্টারবেরি সমভূমিতে উন্নত মানের ঘাস (যেমন – আলফা-আলফা) জন্মায়, যা গবাদি পশুর উৎকৃষ্ট খাদ্য।
- উন্নত প্রযুক্তি: আধুনিক খামার, উন্নত প্রযুক্তিতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ এবং হিমাগারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়।
১৫. অস্ট্রেলিয়ার প্রধান খনিজ সম্পদ কী কী?
অস্ট্রেলিয়া খনিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
- বক্সাইট ও আকরিক লোহা উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম সারিতে রয়েছে।
- সোনা: কালগুরলি ও কুলগার্ডি নামক স্থানে বিখ্যাত সোনার খনি রয়েছে।
- অন্যান্য: এছাড়া কয়লা, নিকেল, ইউরেনিয়াম ও খনিজ তেল পাওয়া যায়।
১৬. ওশিয়ানিয়া মহাদেশের অর্থনৈতিক পরিবেশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
ওশিয়ানিয়ার অর্থনৈতিক পরিবেশ মূলত অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড কেন্দ্রিক।
- কৃষিকাজ: অস্ট্রেলিয়ার মারি-ডার্লিং অববাহিকা (ডাউনস) গম ও ভুট্টা চাষে এবং নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবেরি সমভূমি কৃষিকাজে উন্নত।
- পশুপালন (অস্ট্রেলিয়া): অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম পশম উৎপাদক দেশ। ডাউনস তৃণভূমিতে প্রচুর মেরিনো ভেড়া পালন করা হয়।
- ডেয়ারি শিল্প (নিউজিল্যান্ড): নিউজিল্যান্ড দুগ্ধজাত দ্রব্য (মাখন, পনির) উৎপাদনে ও রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম সারিতে রয়েছে।
- খনিজ সম্পদ: অস্ট্রেলিয়া বক্সাইট, লোহা, সোনা (কালগুরলি খনি) ও কয়লা উত্তোলনে সমৃদ্ধ।
- শিল্প: খনিজ সম্পদ ও পশুপালনের উপর ভিত্তি করে পশম শিল্প, মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, লৌহ-ইস্পাত শিল্প এবং কৃষিভিত্তিক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে উঠেছে। সিডনি, মেলবোর্ন, পার্থ প্রধান শিল্প শহর।