বিষয়: আমাদের পৃথিবী
অধ্যায় ১০: দক্ষিণ আমেরিকা (নোটস)
সাধারণ পরিচিতি
১. দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অবস্থান ও সীমানা লেখো।
অবস্থান: মহাদেশটি মূলত দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত। এর উত্তর অংশ উত্তর গোলার্ধে এবং বেশিরভাগ অংশ দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত।
সীমানা:
- উত্তরে: ক্যারিবিয়ান সাগর ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশ (পানামা খাল দ্বারা বিচ্ছিন্ন)।
- পূর্বে: আটলান্টিক মহাসাগর।
- পশ্চিমে: প্রশান্ত মহাসাগর।
- দক্ষিণে: কুমেরু মহাসাগর।
২. দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম দেশের নাম কী?
ব্রাজিল হলো দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম দেশ।
ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য
৩. আন্দিজ পর্বতমালা (Andes Mountains) কী?
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিম দিক বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা হলো আন্দিজ পর্বতমালা। এটি একটি নবীন ভঙ্গিল পর্বতমালা।
৪. দক্ষিণ আমেরিকার উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের নাম কী?
আন্দিজ পর্বতমালার অ্যাকনকাগুয়া (৬,৯৬০ মি) হলো দক্ষিণ আমেরিকার উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ।
৫. পৃথিবীর উচ্চতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরির নাম কী?
আন্দিজ পর্বতমালার কোটোপ্যাক্সি হলো পৃথিবীর উচ্চতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি।
৬. পৃথিবীর উচ্চতম হ্রদের নাম কী?
আন্দিজ পর্বতমালার বোলিভিয়া মালভূমিতে অবস্থিত টিটিকাকা হ্রদ হলো পৃথিবীর উচ্চতম হ্রদ (নৌচলাচলযোগ্য)।
৭. পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাতের নাম কী?
পূর্বের গায়ানা উচ্চভূমিতে অবস্থিত অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত (ভেনিজুয়েলা) হলো পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত।
৮. দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যভাগের সমভূমি অঞ্চলকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যভাগের সমভূমিকে তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা অঞ্চলে ভাগ করা যায়:
- অরিনোকো নদী অববাহিকা: এই সমভূমির উত্তরাংশে অবস্থিত তৃণভূমি ল্যানোস নামে পরিচিত।
- আমাজন নদী অববাহিকা: মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত এই সুবিশাল চিরসবুজ অরণ্য সেলভা নামে পরিচিত।
- লা প্লাটা নদী অববাহিকা: দক্ষিণের এই সমভূমির দুটি অংশ হলো – গ্রান চ্যাকো (উষ্ণ, অস্বাস্থ্যকর) এবং পম্পাস (নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি)।
৯. দক্ষিণ আমেরিকার ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিবরণ দাও।
ভূপ্রকৃতি অনুসারে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
- পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চল: মহাদেশের পশ্চিম উপকূল বরাবর আন্দিজ পর্বতমালা (পৃথিবীর দীর্ঘতম) অবস্থিত। এটি নবীন ভঙ্গিল পর্বত। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অ্যাকনকাগুয়া। টিটিকাকা হ্রদ, কোটোপ্যাক্সি আগ্নেয়গিরি এখানেই অবস্থিত।
- পূর্বদিকের উচ্চভূমি: এটি প্রাচীন গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ। এর দুটি প্রধান ভাগ হলো – উত্তরের গায়ানা উচ্চভূমি (যেখানে অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত আছে) এবং দক্ষিণের ব্রাজিল উচ্চভূমি।
- মধ্যভাগের সমভূমি: পশ্চিমে আন্দিজ ও পূর্বে উচ্চভূমির মাঝে এই বিশাল সমভূমি অবস্থিত। এটি তিনটি নদী অববাহিকা নিয়ে গঠিত – উত্তরের অরিনোকো অববাহিকা (ল্যানোস তৃণভূমি), মধ্যভাগের আমাজন অববাহিকা (সেলভা অরণ্য) এবং দক্ষিণের লা প্লাটা অববাহিকা (পম্পাস তৃণভূমি)।
চিত্র: দক্ষিণ আমেরিকার ভূপ্রকৃতির তিনটি প্রধান বিভাগ।
নদনদী
১০. আমাজন নদী (Amazon River) সম্পর্কে লেখো।
আমাজন নদী আন্দিজ পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পড়েছে। এটি জলপ্রবাহের দিক থেকে (By volume) পৃথিবীর বৃহত্তম নদী। এর অববাহিকায় পৃথিবীর বৃহত্তম চিরসবুজ অরণ্য ‘সেলভা’ সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রধান উপনদী হলো ম্যাডেইরা ও নিগ্রো।
১১. ইগুয়াজু জলপ্রপাত (Iguazu Falls) কোন নদীর উপর অবস্থিত?
ইগুয়াজু জলপ্রপাত লা প্লাটা নদীর উপনদী পারানার উপর অবস্থিত।
জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদ
১২. সেলভা অরণ্য (Selva Rainforest) কী?
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী অববাহিকায় নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে (সারা বছর প্রচুর উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত) যে সুবিশাল, দুর্ভেদ্য চিরসবুজ অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে, তাকে সেলভা অরণ্য বলে। এই অরণ্য পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য (Tropical Rainforest)। এখানে রাবার, আবলুস, মেহগনি, ব্রাজিল নাট ইত্যাদি গাছ এবং অ্যানাকোন্ডা, ম্যাকাও, টুকান, পিরানহা ইত্যাদি প্রাণী দেখা যায়।
চিত্র: সেলভা অরণ্যের ৪টি প্রধান স্তর।
১৩. ল্যানোস ও পম্পাস তৃণভূমি (Llanos and Pampas) কোথায় দেখা যায়?
- ল্যানোস: অরিনোকো নদী অববাহিকার সাভানা জলবায়ু অঞ্চলে (ক্রান্তীয়) ল্যানোস তৃণভূমি দেখা যায়।
- পম্পাস: লা প্লাটা নদী অববাহিকার নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে পম্পাস তৃণভূমি দেখা যায়।
১৪. আটাকামা মরুভূমি (Atacama Desert) কোথায় অবস্থিত এবং এটি সৃষ্টির কারণ কী?
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমে, আন্দিজ পর্বতমালার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে আটাকামা মরুভূমি অবস্থিত।
সৃষ্টির কারণ:
- এটি আন্দিজ পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে অবস্থিত।
- উপকূল দিয়ে প্রবাহিত শীতল পেরু (বা হামবোল্ট) স্রোতের প্রভাবে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হতে পারে না।
১৫. প্যাটাগোনিয়া মরুভূমি (Patagonian Desert) সৃষ্টির কারণ কী?
আন্দিজ পর্বতমালার পূর্বে, আর্জেন্টিনার দক্ষিণে প্যাটাগোনিয়া মরুভূমি অবস্থিত। এটি আন্দিজ পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এখানে বৃষ্টিপাত কম হয়, তাই এটি একটি নাতিশীতোষ্ণ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
অর্থনৈতিক পরিবেশ
১৬. পম্পাস অঞ্চলকে ‘দক্ষিণ আমেরিকার শস্যভাণ্ডার’ বলা হয় কেন?
আর্জেন্টিনার পম্পাস অঞ্চল একটি উর্বর নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি। এখানকার উর্বর চার্নোজেম মৃত্তিকায় এবং অনুকূল জলবায়ুতে প্রচুর পরিমাণে গম, ভুট্টা ও আখ উৎপাদিত হয়। বিশেষত, গম উৎপাদনে এই অঞ্চল এতটাই উন্নত যে আর্জেন্টিনা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গম রপ্তানিকারক দেশ। তাই পম্পাস অঞ্চলকে ‘দক্ষিণ আমেরিকার শস্যভাণ্ডার’ বলা হয়।
১৭. ‘এস্টানশিয়া’ (Estancia) ও ‘গাউচো’ (Gaucho) কী?
পম্পাস অঞ্চলে পশুপালনের জন্য যে বিশাল তৃণভূমি বা খামার দেখা যায়, তাকে এস্টানশিয়া বলে। এই এস্টানশিয়াগুলিতে যারা পশুপালনের কাজ করে, সেই পশুপালকদের গাউচো (Gaucho) বলা হয়।
১৮. পম্পাস অঞ্চলের পশুপালন ও মাংস শিল্পে উন্নতির কারণ কী?
পম্পাস অঞ্চল পশুপালনে অত্যন্ত উন্নত। এর কারণগুলি হলো:
- বিস্তীর্ণ তৃণভূমি: পশুপালনের জন্য এস্টানশিয়া নামক বিশাল তৃণভূমি রয়েছে।
- উন্নত পশুখাদ্য: এখানকার প্রধান ফসল ভুট্টা এবং তৃণভূমি অঞ্চলের আলফা-আলফা ঘাস উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য।
- জলবায়ু: পশুপালনের উপযোগী নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে।
- মাংস শিল্প: পশুপালনের উপর ভিত্তি করে বুয়েনস আইরেস, লা প্লাটা ইত্যাদি শহরে মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্প (Meat-packing industry) গড়ে উঠেছে, যা পৃথিবীর বিখ্যাত।
১৯. ব্রাজিল কফি উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম কেন?
ব্রাজিল কফি উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে। এর কারণ:
- টেরা রোসা মাটি: ব্রাজিলের উচ্চভূমিতে কফি চাষের উপযোগী বিখ্যাত ‘টেরা রোসা’ (Terra Rossa) নামক উর্বর লাল মাটি দেখা যায়।
- জলবায়ু: উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু ও পরিমিত বৃষ্টিপাত কফি চাষের পক্ষে আদর্শ।
- সুলভ শ্রমিক: কফি বাগিচাগুলিতে (যাদের ‘ফ্যাজেন্দা’ বলে) কাজ করার জন্য প্রচুর সুলভ শ্রমিক পাওয়া যায়।
২০. ‘ফ্যাজেন্দা’ (Fazenda) কী?
ব্রাজিলের বিশাল কফি বাগিচাগুলিকে ‘ফ্যাজেন্দা’ বলা হয়।
২১. দক্ষিণ আমেরিকার কোন হ্রদ খনিজ তেলে সমৃদ্ধ?
ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদ (Lake Maracaibo) খনিজ তেলে সমৃদ্ধ।
২২. ট্রান্স-আমাজন হাইওয়ে (Trans-Amazonian Highway) কী? এর প্রভাব কী?
আমাজন অববাহিকার দুর্গম সেলভা অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত প্রধান রাজপথটিকে ট্রান্স-আমাজন হাইওয়ে বলে।
প্রভাব: এই হাইওয়ে নির্মাণের ফলে অরণ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ সহজ হয়েছে, কিন্তু এর ফলে ব্যাপক হারে অরণ্য ধ্বংস (Deforestation) হচ্ছে, যা পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।