বিষয়: কার্বন ও কার্বনঘটিত যৌগ
অধ্যায় ৪ (নোটস)
কার্বনের রূপভেদ (Allotropes of Carbon)
১. রূপভেদ বা বহুরূপতা কাকে বলে?
যখন কোনো মৌল প্রকৃতিতে বিভিন্ন রূপে অবস্থান করে, যাদের ভৌত ধর্ম আলাদা কিন্তু রাসায়নিক ধর্ম একই, তখন মৌলের এই ধর্মকে বহুরূপতা বা রূপভেদ বলে। রূপগুলি একে অপরের রূপভেদ (Allotrope) হয়।
২. কার্বনের প্রধান রূপভেদগুলি কী কী?
কার্বনের রূপভেদগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- নিয়তাকার (Crystalline): নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার আছে। যেমন: হিরে (Diamond), গ্রাফাইট (Graphite), ফুলারিন (Fullerene)।
- অনিয়তাকার (Amorphous): নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার নেই। যেমন: কোক, চারকোল (অঙ্গার), ভুসোকালি ইত্যাদি।
৩. হিরে (Diamond) -এর গঠন ও ধর্ম লেখো।
- গঠন: হিরের কেলাসে প্রতিটি কার্বন পরমাণু অপর ৪টি কার্বন পরমাণুর সঙ্গে সমযোজী বন্ধনে যুক্ত হয়ে একটি সুষম চতুস্তলকীয় (tetrahedral) গঠন তৈরি করে।
- ভৌত ধর্ম: এটি অত্যন্ত কঠিন (সবচেয়ে কঠিন প্রাকৃতিক পদার্থ), উচ্চ গলনাঙ্কবিশিষ্ট, স্বচ্ছ এবং খুব চকচকে। এটি তাপের সুপরিবাহী কিন্তু তড়িতের কুপরিবাহী (কারণ কোনো মুক্ত ইলেকট্রন থাকে না)।
- ব্যবহার: গহনা তৈরিতে, কাচ কাটতে এবং শল্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
চিত্র: হিরের চতুস্তলকীয় গঠন (একক)।
৪. গ্রাফাইট (Graphite) -এর গঠন ও ধর্ম লেখো।
- গঠন: গ্রাফাইটে কার্বন পরমাণুগুলি সরভুজাকার (hexagonal) স্তরে সজ্জিত থাকে। প্রতিটি কার্বন ৩টি অন্য কার্বনের সাথে যুক্ত থাকে। স্তরগুলি একে অপরের ওপর দুর্বল ভ্যান ডার ওয়ালস বল দ্বারা আবদ্ধ থাকে।
- ভৌত ধর্ম: এটি নরম, পিচ্ছিল, ধূসর বর্ণের কঠিন পদার্থ। এটি তাপ ও তড়িতের সুপরিবাহী (কারণ প্রতি কার্বনের একটি করে ইলেকট্রন মুক্ত থাকে)।
- ব্যবহার: পেনসিলের শিস, পিচ্ছিলকারক পদার্থ (lubricant) এবং তড়িৎদ্বার (electrode) হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
চিত্র: গ্রাফাইটের স্তরীয় গঠন।
৫. হিরে ও গ্রাফাইটের ধর্মের তুলনা করো।
| বৈশিষ্ট্য | হিরে | গ্রাফাইট |
|---|---|---|
| কাঠিন্য | অত্যন্ত কঠিন | নরম ও পিচ্ছিল |
| তড়িৎ পরিবাহিতা | কুপরিবাহী | সুপরিবাহী (ব্যতিক্রমী অধাতু) |
| তাপ পরিবাহিতা | সুপরিবাহী | সুপরিবাহী |
| বর্ণ | স্বচ্ছ, বর্ণহীন | ধূসর, অস্বচ্ছ |
| গঠন | চতুস্তলকীয়, ত্রিমাত্রিক | স্তরীয়, ষড়ভুজাকার |
৬. ফুলারিন (Fullerene) কী?
ফুলারিন হলো কার্বনের একটি নিয়তাকার রূপভেদ। এর অণুগুলি ফুটবল বা বলের মতো দেখতে হয়, যেখানে কার্বন পরমাণুগুলি পঞ্চভুজাকার বা ষড়ভুজাকার বলয় গঠন করে। C60 (বাকমিনস্টারফুলারিন) হলো সবচেয়ে পরিচিত ফুলারিন।
৭. অনিয়তাকার কার্বনের উদাহরণ ও ব্যবহার লেখো।
- কোক (Coke): জ্বালানি হিসেবে এবং ধাতু নিষ্কাশনে বিজারক রূপে ব্যবহৃত হয়।
- চারকোল (Charcoal): জল শোধনে (সক্রিয় চারকোল) এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- ভুসোকালি (Soot): ছাপার কালি ও টায়ার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
কার্বনঘটিত যৌগ (Carbon Compounds)
৮. হাইড্রোকার্বন (Hydrocarbon) কাকে বলে?
শুধুমাত্র কার্বন (C) এবং হাইড্রোজেন (H) পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত জৈব যৌগগুলিকে হাইড্রোকার্বন বলে। যেমন: মিথেন (CH4), ইথেন (C2H6)।
৯. মিথেন (CH4) -এর উৎস ও ধর্ম লেখো।
- উৎস: পচা ডোবা বা জলাভূমির নীচে (তাই একে ‘মার্শ গ্যাস’ বলে), প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উপাদান এবং কয়লা খনিতে পাওয়া যায়।
- ধর্ম: এটি একটি বর্ণহীন, গন্ধহীন গ্যাস। এটি দাহ্য, বায়ুতে নীল শিখায় জ্বলে এবং প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। $CH_4 + 2O_2 \rightarrow CO_2 + 2H_2O + \text{তাপ}$
- ব্যবহার: এটি প্রধানত জ্বালানি (CNG) হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১০. পলিমার (Polymer) ও মনোমার (Monomer) কী?
- মনোমার: যে ক্ষুদ্র অণুগুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে পলিমার গঠন করে, তাদের মনোমার বলে। যেমন: পলিথিনের মনোমার হলো ইথিলিন।
- পলিমার: যখন অনেকগুলি ছোট অণু (মনোমার) পরস্পর সমযোজী বন্ধনে যুক্ত হয়ে একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলযুক্ত বৃহৎ অণু গঠন করে, তখন সেই বৃহৎ অণুটিকে পলিমার বলে। এই প্রক্রিয়াকে পলিমারাইজেশন বলে।
১১. কয়েকটি পলিমারের মনোমার ও ব্যবহার লেখো।
| পলিমার | মনোমার | ব্যবহার |
|---|---|---|
| পলিথিন | ইথিলিন (C2H4) | প্যাকেট, ব্যাগ, বোতল তৈরিতে। |
| PVC (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) | ভিনাইল ক্লোরাইড | জল ও বিদ্যুতের পাইপ, রেইনকোট তৈরিতে। |
| টেফলন | টেট্রাফ্লুরোইথিলিন | নন-স্টিক বাসনপত্রের প্রলেপ দিতে। |
কার্বনের অক্সাইড (Oxides of Carbon)
১২. কার্বন মনোক্সাইড (CO) কীভাবে উৎপন্ন হয়?
অক্সিজেনের অপর্যাপ্ত সরবরাহে কার্বন বা কার্বনঘটিত যৌগের অসম্পূর্ণ দহনের ফলে কার্বন মনোক্সাইড (CO) গ্যাস উৎপন্ন হয়।
বিক্রিয়া: $2C + O_2 \text{(অসম্পূর্ণ)} \rightarrow 2CO$
১৩. কার্বন মনোক্সাইড (CO) -কে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয় কেন?
কার্বন মনোক্সাইড (CO) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত গ্যাস। এটি বর্ণহীন ও গন্ধহীন হওয়ায় এর উপস্থিতি সহজে বোঝা যায় না। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করলে এটি রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে অক্সিজেনের তুলনায় প্রায় ২৫০-৩০০ গুণ বেশি আসক্তিতে যুক্ত হয়ে কার্বক্সি-হিমোগ্লোবিন নামক স্থায়ী যৌগ গঠন করে। এর ফলে হিমোগ্লোবিন আর অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে না, ফলে কোষে অক্সিজেনের অভাবে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই কারণে একে ‘নীরব ঘাতক’ বলে।
১৪. গ্রিনহাউস প্রভাব (Greenhouse Effect) কী?
বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), জলীয় বাষ্প ইত্যাদি গ্যাসগুলি সূর্য থেকে আসা ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয় না, কিন্তু পৃথিবী থেকে বিকিরিত দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত রশ্মি (তাপ) শোষণ করে এবং পুনরায় ভূপৃষ্ঠে বিকিরণ করে। এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। কাচের ঘরের (গ্রিনহাউস) মতো এই ঘটনাকে গ্রিনহাউস প্রভাব বলে।
চিত্র: গ্রিনহাউস প্রভাব।
১৫. বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) কী?
গ্রিনহাউস প্রভাবের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির (বিশেষত CO2) পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ঘটনাকে বিশ্ব উষ্ণায়ন বলে।
১৬. বিশ্ব উষ্ণায়নের দুটি ক্ষতিকর প্রভাব লেখো।
- মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে উপকূলবর্তী নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
- জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, যার ফলে খরা, বন্যা ও ঝড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।