বিষয়: আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও উদ্ভিদজগৎ
অধ্যায় ১১ (নোটস)
বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem)
১. বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) কাকে বলে?
কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে বসবাসকারী জীবগোষ্ঠী (উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব) এবং সেই পরিবেশের জড় উপাদানগুলির (জল, বায়ু, মাটি, আলো) মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ও নির্ভরতার মাধ্যমে যে সুসংহত তন্ত্র গড়ে ওঠে, তাকে বাস্তুতন্ত্র বলে।
২. বাস্তুতন্ত্রের প্রধান উপাদানগুলি কী কী?
বাস্তুতন্ত্রের প্রধান দুটি উপাদান হলো:
- জড় উপাদান (Abiotic): যেমন – আলো, বায়ু, জল, মাটি, তাপমাত্রা, খনিজ লবণ ইত্যাদি।
- জীব উপাদান (Biotic):
- উৎপাদক (Producer): সবুজ উদ্ভিদ, যারা সালোকসংশ্লেষ করে।
- খাদক (Consumer): প্রাণী, যারা উৎপাদক বা অন্য প্রাণীকে খায়।
- বিয়োজক (Decomposer): ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, যারা মৃত জীবদেহকে ভাঙে।
৩. উৎপাদক (Producer) কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
বাস্তুতন্ত্রের যে জীব উপাদানরা (মূলত সবুজ উদ্ভিদ) সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে, তাদের উৎপাদক বলে। যেমন: আম গাছ, ঘাস, শৈবাল।
৪. খাদক (Consumer) কাকে বলে?
বাস্তুতন্ত্রের যে জীব উপাদানরা (প্রাণী) খাদ্য তৈরির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎপাদকের উপর নির্ভরশীল, তাদের খাদক বলে।
৫. খাদকের শ্রেণিবিভাগ করো।
- প্রাথমিক খাদক (Primary Consumer): যারা সরাসরি উৎপাদককে (উদ্ভিদ) খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এরা তৃণভোজী। যেমন: হরিণ, গরু, ফড়িং।
- গৌণ খাদক (Secondary Consumer): যারা প্রাথমিক খাদককে (তৃণভোজী প্রাণী) খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এরা মাংসাশী। যেমন: বাঘ, সাপ, ব্যাঙ।
- প্রগৌণ খাদক (Tertiary Consumer): যারা গৌণ খাদককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। যেমন: ময়ূর (সাপ খায়), বাজপাখি (ব্যাঙ খায়)।
৬. বিয়োজক (Decomposer) কাকে বলে? বাস্তুতন্ত্রে এদের গুরুত্ব কী?
যেসব অণুজীব (প্রধানত ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া) মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষকে ভেঙে বা বিয়োজিত করে সরল অজৈব যৌগে পরিণত করে এবং নিজেদের পুষ্টি সংগ্রহ করে, তাদের বিয়োজক বলে।
গুরুত্ব: বিয়োজকরা মৃত জৈব পদার্থকে ভেঙে খনিজ লবণ মাটিতে ফিরিয়ে দেয়, যা উৎপাদক (উদ্ভিদ) পুনরায় গ্রহণ করে। এইভাবে এরা পরিবেশে পুষ্টির চক্রাকার আবর্তন ঘটায় ও পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখে।
৭. খাদ্যশৃঙ্খল বা ফুড চেন (Food Chain) কাকে বলে?
বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের খাদকের মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে শক্তির প্রবাহ একটি সরলরৈখিক পথে ঘটে, তাকে খাদ্যশৃঙ্খল বলে।
যেমন: ঘাস (উৎপাদক) → ফড়িং (প্রাথমিক খাদক) → ব্যাঙ (গৌণ খাদক) → সাপ (প্রগৌণ খাদক)
চিত্র: একটি সরল খাদ্যশৃঙ্খল।
৮. খাদ্যজাল বা ফুড ওয়েব (Food Web) কাকে বলে?
কোনো বাস্তুতন্ত্রে একাধিক খাদ্যশৃঙ্খল পরস্পর জালের মতো যুক্ত হয়ে যে জটিল খাদ্য-খাদক সম্পর্ক তৈরি করে, তাকে খাদ্যজাল বলে। খাদ্যজালে একটি খাদক একাধিক খাদ্যশৃঙ্খলের অংশ হতে পারে।
উদ্ভিদজগতের শ্রেণিবিভাগ
৯. মস (Moss) বা মসবর্গীয় উদ্ভিদ কী?
মস হলো অপুষ্পক উদ্ভিদের একটি প্রাচীনতম শ্রেণি। এদের দেহ কাণ্ড ও পাতার মতো অংশে বিভক্ত থাকলেও প্রকৃত মূল, কাণ্ড বা পাতা থাকে না (মূলের বদলে রাইজয়েড থাকে)। এরা সাধারণত স্যাঁতসেঁতে ছায়াময় স্থানে জন্মায়। যেমন: Polytrichum।
১০. ফার্ন (Fern) বা ফার্নবর্গীয় উদ্ভিদ কী?
ফার্ন হলো অপুষ্পক উদ্ভিদের একটি উন্নত শ্রেণি। এদের দেহে সুস্পষ্ট মূল, কাণ্ড (রাইজোম) ও পাতা থাকে এবং কাণ্ডে সংবহন কলা (জাইলেম-ফ্লোয়েম) দেখা যায়। এদের পাতাকে ‘ফার্ন’ (Frond) বলে। যেমন: ঢেঁকিশাক, শুশনি শাক।
১১. সপুষ্পক উদ্ভিদ (Flowering Plants) কাকে বলে?
যেসব উদ্ভিদের ফুল, ফল ও বীজ হয়, তাদের সপুষ্পক উদ্ভিদ বলে। যেমন: আম, ধান।
১২. একবীজপত্রী (Monocot) ও দ্বিবীজপত্রী (Dicot) উদ্ভিদের মধ্যে পার্থক্য লেখো।
| বৈশিষ্ট্য | একবীজপত্রী উদ্ভিদ | দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ |
|---|---|---|
| বীজপত্র | বীজে একটি মাত্র বীজপত্র থাকে। | বীজে দুটি বীজপত্র থাকে। |
| মূল | গুচ্ছমূল (Fibrous Root) দেখা যায়। | স্থানিক মূল (Tap Root) দেখা যায়। |
| পাতা | পাতার শিরাবিন্যাস সমান্তরাল (Parallel)। | পাতার শিরাবিন্যাস জালিকাকার (Reticulate)। |
| ফুল | ফুলের অংশগুলি সাধারণত তিনটি বা তিনের গুণিতক হয়। | ফুলের অংশগুলি সাধারণত চারটি বা পাঁচটি বা তাদের গুণিতক হয়। |
| উদাহরণ | ধান, গম, ভুট্টা, কলা, ঘাস, পেঁয়াজ। | আম, জাম, মটর, ছোলা, সূর্যমুখী, জবা। |
চিত্র: একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের পাতা ও মূল।
উদ্ভিদের অঙ্গসমূহ
১৩. একটি আদর্শ সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রধান অংশগুলি কী কী?
একটি আদর্শ সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রধান অংশগুলি হলো: মূল (Root), কাণ্ড (Stem), পাতা (Leaf), ফুল (Flower) ও ফল (Fruit)।
১৪. মূল (Root) কাকে বলে? এর প্রধান কাজ কী?
উদ্ভিদের যে অংশটি সাধারণত মাটির নীচে বৃদ্ধি পায় এবং আলো থেকে দূরে সরে যায়, তাকে মূল বলে।
কাজ:
- গাছকে মাটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ রাখা।
- মাটি থেকে জল ও খনিজ লবণ শোষণ করা।
- খাদ্য সঞ্চয় করা (যেমন – গাজর, মুলা)।
১৫. কাণ্ড (Stem) কাকে বলে? এর প্রধান কাজ কী?
উদ্ভিদের যে অংশটি মাটির উপরে আলোর দিকে বৃদ্ধি পায় এবং পাতা, ফুল, ফল ধারণ করে, তাকে কাণ্ড বলে।
কাজ:
- গাছের ভার বহন করা এবং পাতা, ফুল, ফলকে ধরে রাখা।
- মূল দ্বারা শোষিত জল ও খনিজ লবণ পাতায় পৌঁছে দেওয়া।
- পাতায় উৎপন্ন খাদ্য সারা দেহে ছড়িয়ে দেওয়া।
১৬. পাতা (Leaf) কাকে বলে? এর প্রধান কাজ কী?
কাণ্ড বা শাখা-প্রশাখার পর্ব থেকে উৎপন্ন চ্যাপ্টা, সবুজ বর্ণের অংশকে পাতা বলে।
কাজ:
- সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis): সূর্যালোক ও ক্লোরোফিলের সাহায্যে খাদ্য তৈরি করা (প্রধান কাজ)।
- বাষ্পমোচন (Transpiration): পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে দেহের অতিরিক্ত জল বাষ্পাকারে বের করে দেওয়া।
- গ্যাসের আদানপ্রদান (শ্বাসকার্য)।
১৭. সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis) কাকে বলে?
যে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদরা (ক্লোরোফিলযুক্ত) সূর্যালোকের উপস্থিতিতে, পরিবেশ থেকে শোষিত জল (H2O) ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের (CO2) বিক্রিয়ায় শর্করা (গ্লুকোজ) জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন করে এবং উপজাত বস্তু হিসেবে অক্সিজেন (O2) ত্যাগ করে, তাকে সালোকসংশ্লেষ বলে।
সমীকরণ: 6CO2 + 6H2O → (সূর্যালোক / ক্লোরোফিল) → C6H12O6 + 6O2
১৮. একটি আদর্শ ফুলের প্রধান অংশগুলি কী কী?
একটি আদর্শ ফুলের প্রধান চারটি স্তবক (whorl) হলো:
- বৃত্তি (Calyx): বাইরের সবুজ রঙের স্তবক, যা কুঁড়ি অবস্থায় ফুলকে রক্ষা করে। (অংশ: বৃত্যংশ)
- দলমণ্ডল (Corolla): রঙিন পাপড়ির স্তবক, যা পরাগমিলনের জন্য পতঙ্গকে আকর্ষণ করে। (অংশ: দল বা পাপড়ি)
- পুংস্তবক (Androecium): এটি ফুলের পুং জনন অঙ্গ। (অংশ: পুংকেশর)
- স্ত্রীস্তবক (Gynoecium): এটি ফুলের স্ত্রী জনন অঙ্গ। (অংশ: গর্ভকেশর)
চিত্র: একটি আদর্শ ফুলের প্রধান অংশসমূহ।
১৯. উদ্ভিদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব লেখো।
- খাদ্য হিসেবে: সমস্ত খাদ্যশস্য (ধান, গম), শাকসবজি ও ফল আমরা উদ্ভিদ থেকে পাই।
- কাঠ: আসবাবপত্র, বাড়িঘর ও জ্বালানির জন্য আমরা উদ্ভিদের (শাল, সেগুন) ওপর নির্ভরশীল।
- ঔষধ: অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ (যেমন – কুইনাইন, মরফিন) উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়। (সিঙ্কোনা, সর্পগন্ধা, তুলসী)।
- পরিবেশগত: সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে উদ্ভিদ পরিবেশের O2 ও CO2-এর ভারসাম্য বজায় রাখে।