বিষয়: মানুষের খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদন
অধ্যায় ৮ (নোটস)
খাদ্যের প্রধান উপাদানসমূহ
১. খাদ্য কাকে বলে?
যেসব আহার্য সামগ্রী গ্রহণ করলে জীবদেহের বৃদ্ধি, পুষ্টি, ক্ষয়পূরণ ও শক্তি উৎপাদন হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তাদের খাদ্য বলে।
২. খাদ্যের প্রধান উপাদানগুলি কী কী?
খাদ্যের প্রধান উপাদানগুলি হলো:
- কার্বোহাইড্রেট (শর্করা)
- প্রোটিন (আমিষ)
- ফ্যাট (স্নেহ পদার্থ)
- ভিটামিন (খাদ্যপ্রাণ)
- খনিজ লবণ
- জল
এর মধ্যে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে, তাই এদের ‘শক্তি-উৎপাদক খাদ্য’ (বা ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট) বলে। ভিটামিন, খনিজ লবণ ও জল দেহ সংরক্ষণে সাহায্য করে, এদের ‘দেহ-সংরক্ষক খাদ্য’ (বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) বলে।
৩. কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা কী?
কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H) ও অক্সিজেন (O) নিয়ে গঠিত যে খাদ্য উপাদান দেহের শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে, তাকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা বলে। যেমন: গ্লুকোজ, শ্বেতসার (স্টার্চ)।
৪. কার্বোহাইড্রেটের প্রধান কাজ কী?
- দেহে শক্তি উৎপাদন করা (প্রধান কাজ)।
- কোষ গঠনে সহায়তা করা।
- খাদ্যতন্তু (ফাইবার) হিসেবে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা।
৫. প্রোটিন বা আমিষ কী? এর কাজ কী?
কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন (অনেক সময় সালফার) নিয়ে গঠিত যে খাদ্য উপাদান জীবদেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করে, তাকে প্রোটিন বলে।
কাজ:
- দেহের বৃদ্ধি ও নতুন কোশ গঠন করা।
- দেহের ক্ষয়পূরণ করা (যেমন – ক্ষত নিরাময়)।
- উৎসেচক, হরমোন ও অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করা।
৬. প্রোটিনের অভাবে শিশুদের কী রোগ হয়?
প্রোটিনের অভাবে শিশুদের কোয়াশিয়রকর (Kwashiorkor) ও ম্যারাসমাস (Marasmus) রোগ হয়।
চিত্র: খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানের কিছু উৎস।
৭. ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ কী? এর কাজ কী?
কার্বোহাইড্রেটের মতোই কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নিয়ে গঠিত যে খাদ্য উপাদান দেহে শক্তির উৎস রূপে সঞ্চিত থাকে, তাকে ফ্যাট বলে।
কাজ:
- দেহে শক্তি সঞ্চয় করে রাখা (ভবিষ্যতের শক্তির উৎস)।
- দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন (A, D, E, K) শোষণে সাহায্য করা।
৮. ভিটামিন (Vitamin) কাকে বলে?
ভিটামিন হলো এক প্রকার জৈব যৌগ যা জীবদেহে খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়, কিন্তু দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
৯. দ্রাব্যতা অনুসারে ভিটামিন কয় প্রকার ও কী কী?
দ্রাব্যতা অনুসারে ভিটামিন দুই প্রকার:
- ফ্যাটে (স্নেহ পদার্থে) দ্রবণীয় ভিটামিন: ভিটামিন A, D, E, K।
- জলে দ্রবণীয় ভিটামিন: ভিটামিন B কমপ্লেক্স ও ভিটামিন C।
১০. বিভিন্ন ভিটামিনের উৎস ও অভাবজনিত রোগের তালিকা দাও।
| ভিটামিন | প্রধান কাজ | অভাবজনিত রোগ | প্রধান উৎস |
|---|---|---|---|
| ভিটামিন A | দৃষ্টিশক্তি ও ত্বক ভালো রাখে | রাতকানা (Night Blindness) | গাজর, পাকা আম, দুধ, ডিম |
| ভিটামিন B কমপ্লেক্স | স্নায়ু ও পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ রাখে | বেরিবেরি, মুখে ঘা | ঢেঁকিছাঁটা চাল, বাদাম, দুধ |
| ভিটামিন C | দাঁতের মাড়ি ও ত্বক সুস্থ রাখে, রোগ প্রতিরোধ করে | স্কার্ভি (মাড়ি থেকে রক্ত পড়া) | লেবু, আমলকি, পেয়ারা, কাঁচালঙ্কা |
| ভিটামিন D | হাড় ও দাঁত গঠনে সাহায্য করে | রিকেট (শিশুদের), অস্টিওম্যালেসিয়া (বড়দের) | সূর্যের আলো, দুধ, ডিম, মাছের যকৃৎ |
| ভিটামিন E | ত্বক ভালো রাখে, বন্ধ্যাত্ব প্রতিরোধ করে | বন্ধ্যাত্ব, ত্বকের সমস্যা | উদ্ভিজ্জ তেল, বাদাম |
| ভিটামিন K | রক্ত তঞ্চনে (জমাট বাঁধতে) সাহায্য করে | রক্তক্ষরণ (Hemophilia) | বাঁধাকপি, পালং শাক, টমেটো |
১১. খনিজ লবণ (Minerals) কাকে বলে?
জীবদেহের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য এবং বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অজৈব উপাদানগুলি খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হয়, তাদের খনিজ লবণ বলে। যেমন: লোহা, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন।
১২. প্রধান কয়েকটি খনিজ লবণের কাজ ও অভাবজনিত রোগ লেখো।
| খনিজ লবণ | প্রধান কাজ | অভাবজনিত রোগ | প্রধান উৎস |
|---|---|---|---|
| ক্যালসিয়াম (Ca) | হাড় ও দাঁত গঠন, রক্ত তঞ্চন | রিকেট, হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া | দুধ, ছোট মাছ, ডিম |
| লোহা (Fe) | রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠন (অক্সিজেন পরিবহন) | অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা | শাক (পালং, পুঁই), মোচা, যকৃৎ |
| আয়োডিন (I) | থাইরয়েড হরমোন গঠন, মানসিক বৃদ্ধি | গয়টার বা গলগণ্ড রোগ | আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ |
| সোডিয়াম (Na) | দেহে জলের ভারসাম্য ও স্নায়ুর কাজ নিয়ন্ত্রণ | রক্তচাপ কমে যাওয়া, পেশির টান | খাদ্য লবণ, চিজ |
খাদ্য উৎপাদন
১৩. কৃষিবিজ্ঞান (Agriculture) কাকে বলে?
বিজ্ঞানের যে শাখায় ফসল উৎপাদন, প্রাণীপালন, মৎস্যচাষ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও গবেষণা করা হয়, তাকে কৃষিবিজ্ঞান বলে।
১৪. ভারতের দুটি প্রধান খাদ্যশস্যের নাম কী?
ধান (চাল) ও গম।
১৫. শস্য আবর্তন বা শস্য পর্যায় (Crop Rotation) কাকে বলে?
একই জমিতে প্রতি বছর একই ফসল চাষ না করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসল (বিশেষত একটি শস্য ও একটি ডাল জাতীয় শস্য) চাষ করার পদ্ধতিকে শস্য আবর্তন বলে।
উপকারিতা: এর ফলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে। কারণ ডাল জাতীয় উদ্ভিদের মূলের অর্বুদে থাকা রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে, যা পরবর্তী ফসলের সার হিসেবে কাজ করে।
১৬. রাসায়নিক সার ও জৈব সারের দুটি পার্থক্য লেখো।
| বৈশিষ্ট্য | রাসায়নিক সার | জৈব সার (কম্পোস্ট) |
|---|---|---|
| উপাদান | অজৈব রাসায়নিক পদার্থ (যেমন – ইউরিয়া, সুপারফসফেট)। | জীবদেহ থেকে (উদ্ভিদ ও প্রাণীর বর্জ্য) পচিয়ে তৈরি হয়। |
| প্রভাব | দ্রুত কাজ করে, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটি দূষিত হয়। | ধীরে কাজ করে, মাটির উর্বরতা ও জলধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। |
১৭. ‘সবুজ বিপ্লব’ (Green Revolution) কী?
উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক জলসেচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৯৬০-এর দশকে ভারতে (বিশেষত গম ও ধানের) খাদ্যশস্য উৎপাদনে যে যুগান্তকারী বৃদ্ধি ঘটে, তাকে ‘সবুজ বিপ্লব’ বলে।
১৮. ‘শ্বেত বিপ্লব’ (White Revolution) কী?
সমবায় প্রথা ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাকে ‘শ্বেত বিপ্লব’ বলে। এর জনক ছিলেন ডঃ ভার্গিস কুরিয়েন।
১৯. ‘নীল বিপ্লব’ (Blue Revolution) কী?
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ (বিশেষত অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে) করে মাছের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি করার ঘটনাকে ‘নীল বিপ্লব’ বলে।
২০. পোল্ট্রি (Poultry) কাদের বলা হয়?
ডিম ও মাংস পাওয়ার জন্য যেসব পাখিদের পালন করা হয়, তাদের পোল্ট্রি বলে। যেমন: হাঁস, মুরগি।
২১. ব্রয়লার (Broiler) ও লেয়ার (Layer) মুরগি কাকে বলে?
- ব্রয়লার: যেসব মুরগি মূলত মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়।
- লেয়ার: যেসব মুরগি মূলত ডিম পাড়ার জন্য পালন করা হয়।
২২. মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত দুটি প্রধান সারের নাম লেখো।
অজৈব সার: সুপারফসফেট।
জৈব সার: সরষের খোল।
(এগুলি পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য বা প্ল্যাঙ্কটন জন্মাতে সাহায্য করে)।