চূড়ান্ত মহা-সাজেশন (৫ নম্বর): অতীত ও ঐতিহ্য
প্রসেসিং…

বিষয়: অতীত ও ঐতিহ্য (অষ্টম শ্রেণি)

চূড়ান্ত মহা-সাজেশন (শুধুমাত্র ৫ নম্বরের প্রশ্ন)

অধ্যায় ১: ইতিহাসের ধারণা

১. জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে কীভাবে ভাগ করেছেন? এই যুগ বিভাজনের সমস্যাগুলি কী কী? [৫ নম্বর]

উত্তর:

জেমস মিলের যুগ বিভাজন: ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস মিল তাঁর ‘History of British India’ গ্রন্থে ভারতের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করেন: ১) হিন্দু যুগ, ২) মুসলিম যুগ, এবং ৩) ব্রিটিশ যুগ।

সমস্যা: এই বিভাজনটি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।

  • সাম্প্রদায়িক বিভাজন: প্রথম দুটি যুগের নামকরণ শাসকের ধর্মের নামে করা হয়েছে (হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ), কিন্তু শেষ যুগের নামকরণ শাসকের জাতির নামে (ব্রিটিশ যুগ) করা হয়েছে, ‘খ্রিস্টান যুগ’ নয়। এটি প্রমাণ করে যে মিল ব্রিটিশ সভ্যতাকে ধর্মের ঊর্ধ্বে শ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন।
  • অঐতিহাসিক: প্রাচীন ভারতে কেবল হিন্দু রাজাই ছিলেন না, বৌদ্ধ (অশোক) বা জৈন রাজারাও ছিলেন। একইভাবে মধ্যযুগেও বহু হিন্দু রাজ্য (যেমন বিজয়নগর) ছিল। তাই ‘হিন্দু যুগ’ বা ‘মুসলিম যুগ’ নামকরণ অঐতিহাসিক।
  • সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য: মিল দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ শাসনের আগের দুটি যুগই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, স্বৈরাচারী ও কুসংস্কারে ভরা। একমাত্র ব্রিটিশ শাসনই ভারতকে ‘সভ্য’ ও ‘আধুনিক’ করেছে। এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বৈধতা দিতে চেয়েছিলেন।
  • অতি-সরলীকরণ: এই বিভাজন একটি যুগের জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শাসকের ধর্মকে গুরুত্ব দিয়েছে, যা ইতিহাসের অতি-সরলীকরণ।

২. আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ফটোগ্রাফ (আলোকচিত্র) এবং আত্মজীবনীর সীমাবদ্ধতাগুলি আলোচনা করো। [৫ নম্বর]

উত্তর: আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় ফটোগ্রাফ এবং আত্মজীবনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও এদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

ফটোগ্রাফের সীমাবদ্ধতা:

  • ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি: ফটোগ্রাফ কোনো সম্পূর্ণ সত্যকে তুলে ধরে না। যিনি ছবিটি তুলছেন, তিনি একটি বিশেষ মুহূর্তকে, একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ক্যামেরা-বন্দী করেন। এটি ফটোগ্রাফারের ব্যক্তিগত রুচি, পছন্দ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
  • অসম্পূর্ণ চিত্র: একটি ছবি একটি ঘটনার খণ্ডচিত্র মাত্র, তার আগের বা পরের ঘটনা ছবিতে ধরা পড়ে না। যেমন, হরিপুরা কংগ্রেসে গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্রের হাস্যরত ছবি দেখে তাঁদের তৎকালীন রাজনৈতিক সংঘাতের গভীরতা বোঝা যায় না।

আত্মজীবনীর সীমাবদ্ধতা:

  • ব্যক্তিগত মতামত: আত্মজীবনী লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্মৃতি ও মতামতের ওপর নির্ভরশীল। লেখক অনেক সময় নিজের দোষত্রুটি গোপন করেন বা নিজের ভূমিকাকে বড় করে দেখান।
  • স্মৃতির বিকৃতি: দীর্ঘদিন পরে স্মৃতি থেকে লেখার ফলে ঘটনার বিকৃতি ঘটা বা তারিখের ভুল হওয়া স্বাভাবিক।
  • তথ্য গোপন: লেখক অনেক সময় বিতর্কিত বা অপ্রিয় সত্য ঘটনা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যান বা গোপন করেন।

তাই ঐতিহাসিককে এই ধরনের উপাদান ব্যবহার করার সময় অন্যান্য তথ্যের সাথে তা যাচাই করে নিতে হয়।

অধ্যায় ২: আঞ্চলিক শক্তির উত্থান

৩. ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১৭৭০) কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো। এর জন্য কি শুধু খরা দায়ী ছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১১৭৬ বঙ্গাব্দ) বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত।

কারণ:

  • প্রাকৃতিক কারণ (অজুহাত মাত্র): ১৭৬৮-৬৯ সালে অনাবৃষ্টি ও খরার ফলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এটি দুর্ভিক্ষের একটি কারণ হলেও, প্রধান কারণ ছিল না।
  • কোম্পানির ‘দ্বৈত শাসন’ (প্রধান কারণ): ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় ‘দ্বৈত শাসন’ চালু হয়। এতে কোম্পানির হাতে থাকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা, আর নবাবের হাতে থাকে ক্ষমতাহীন শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব।
  • অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা: কোম্পানি শুধুমাত্র মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ইজারাদারদের মাধ্যমে নির্মমভাবে চড়া হারে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। খরার সময়ও রাজস্ব ছাড় দেওয়া হয়নি, বরং পরের বছরের রাজস্বও অগ্রিম আদায় করা হয়।
  • কোম্পানির উদাসীনতা: দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরেও কোম্পানি বা তার কর্মচারীরা প্রজাদের সাহায্যের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। তারা খাদ্যশস্য মজুত করে চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটছিল।

ফলাফল:

এই মন্বন্তরে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (প্রায় ১ কোটি) অনাহারে ও রোগে মারা যায়। অসংখ্য গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে, কৃষিজমি জঙ্গলে পরিণত হয় এবং বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।

৪. মীরকাশিমের সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধের কারণগুলি কী ছিল? এই বিরোধের ফলাফল কী হয়েছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: মীরজাফরের পর মীরকাশিম বাংলার নবাব হন। তিনি কোম্পানির হাতের পুতুল হয়ে থাকতে চাননি, বরং একজন স্বাধীন নবাবের মতো শাসন করতে চেয়েছিলেন। এটাই ছিল বিরোধের মূল কারণ।

বিরোধের কারণ:

  1. রাজধানী স্থানান্তর: মীরকাশিম কোম্পানির প্রভাব এড়াতে রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে (বিহারে) সরিয়ে নিয়ে যান।
  2. সেনাবাহিনী সংস্কার: তিনি ইউরোপীয় ধাঁচে নিজস্ব সেনাবাহিনী ও অস্ত্রাগার গড়ে তোলেন, যা কোম্পানি ভালো চোখে দেখেনি।
  3. ‘দস্তক’-এর অপব্যবহার (প্রধান কারণ): কোম্পানির কর্মচারীরা ‘দস্তক’ বা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিগত व्यापार করত, ফলে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল এবং নবাব রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। মীরকাশিম এর প্রতিবাদ করেন।
  4. শুল্ক প্রত্যাহার: কোম্পানিকে শায়েস্তা করতে মীরকাশিম শেষ পর্যন্ত সমস্ত ভারতীয় বণিকের ওপর থেকেও বাণিজ্য শুল্ক তুলে নেন। এর ফলে ব্রিটিশ বণিকরা তাদের বিশেষ সুবিধা হারায় এবং সরাসরি নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।

ফলাফল: এই বিরোধের ফলে ১৭৬৩ সালে কোম্পানির সঙ্গে মীরকাশিমের যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি পরাজিত হয়ে অযোধ্যায় পালিয়ে যান এবং অযোধ্যার নবাব ও মুঘল সম্রাটের সাথে জোট বাঁধেন। এই জোট চূড়ান্তভাবে ১৭৬৪ সালে **বক্সারের যুদ্ধে** পরাজিত হয়।

অধ্যায় ৩: ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা

৫. ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড কর্নওয়ালিসের বিচারব্যবস্থার সংস্কারগুলির তুলনামূলক আলোচনা করো। [৫ নম্বর]

উত্তর: ভারতে কোম্পানি শাসনের বিচারব্যবস্থাকে সংগঠিত করতে হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিস দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।

ওয়ারেন হেস্টিংসের সংস্কার (ভিত্তি স্থাপন):

  • তিনি ১৭৭২ সালে প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘দেওয়ানি’ (সিভিল) ও ‘ফৌজদারি’ (ক্রিমিনাল) আদালত স্থাপন করেন।
  • দেওয়ানি আদালতের ভার দেন ইউরোপীয় কালেক্টরদের হাতে, তবে হিন্দু ও মুসলিম আইন ব্যাখ্যার জন্য পণ্ডিত ও মৌলবীদের রাখা হয়।
  • ফৌজদারি আদালত কাজি ও মুফতির অধীনে থাকলেও তাতেও কালেক্টরের নজরদারি থাকত।
  • কলকাতায় ‘সদর দেওয়ানি’ ও ‘সদর নিজামত’ নামে দুটি সর্বোচ্চ আপিল আদালত স্থাপন করেন।

লর্ড কর্নওয়ালিসের সংস্কার (চূড়ান্ত রূপদান):

  • হেস্টিংসের কাঠামোকে তিনি আরও উন্নত করেন। তিনি ‘কর্ণওয়ালিস কোড’ (১৭৯৩) চালু করেন।
  • তিনি **ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ** করেন। অর্থাৎ, রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব (কালেক্টর) এবং বিচার করার দায়িত্ব (জজ) সম্পূর্ণ আলাদা করে দেন।
  • তিনি নিম্ন আদালত (মুনসেফ, সদর আমিন) থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সদর আদালত পর্যন্ত একটি সুগঠিত ও স্তরভিত্তিক বিচারব্যবস্থা চালু করেন।
  • তিনি ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ইউরোপীয়করণ করেন, অর্থাৎ উচ্চ পদ থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে দেন।

উপসংহার: হেস্টিংস যে বিচার কাঠামোর সূচনা করেছিলেন, কর্নওয়ালিস তাকেই সুসংহত করে ‘আইনের শাসন’ ও ‘ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ’-এর মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ দেন।

৬. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে ‘সামরিক জাতি’ (Martial Races) তত্ত্বের প্রবর্তন কেন করা হয়েছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই বিদ্রোহে মূলত বাংলা ও অযোধ্যার উচ্চবর্ণের (ব্রাহ্মণ, রাজপুত) সিপাহিরা যোগ দিয়েছিল।

‘সামরিক জাতি’ তত্ত্ব:

ব্রিটিশ শাসকরা একটি তত্ত্ব প্রচার করে যে, ভারতের সব জাতি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী নয়। তাদের মতে, পাঞ্জাবের শিখ, জাঠ, উত্তর-পশ্চিমের পাঠান এবং নেপালি গুর্খাদের মতো কিছু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীই “সামরিক জাতি”, কারণ তারা স্বভাবগতভাবে সাহসী, বিশ্বস্ত এবং যুদ্ধের উপযুক্ত।

উদ্দেশ্য:

  1. বিভাজন ও শাসন: সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘সামরিক’ ও ‘অসামরিক’ জাতির বিভাজন তৈরি করা, যাতে সিপাহিরা আর কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে।
  2. আনুগত্য নিশ্চিত করা: ব্রিটিশরা মনে করত, এই তথাকথিত ‘সামরিক জাতিগুলি’ (যারা ১৮৫৭-র বিদ্রোহে মূলত ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিল) ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বেশি অনুগত থাকবে।
  3. বিদ্রোহী অঞ্চলকে শাস্তি: যে অঞ্চলগুলি বিদ্রোহ করেছিল (যেমন অযোধ্যা) সেখান থেকে সেনা নিয়োগ কমিয়ে দেওয়া হয়।

এই নীতির ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাঠামো বদলে যায় এবং ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতিটি সেনাবাহিনীর মধ্যেও প্রয়োগ করা হয়।

অধ্যায় ৪: ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র

৭. ঔপনিবেশিক ভারতে রেলপথ স্থাপনের পিছনে ব্রিটিশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? এটি কি ভারতের অর্থনীতিকে সাহায্য করেছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: লর্ড ডালহৌসির আমলে (১৮৫৩) ভারতে রেলপথ স্থাপন শুরু হয়।

ব্রিটিশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য:

  1. সামরিক উদ্দেশ্য: দেশের যেকোনো প্রান্তে বিদ্রোহ দেখা দিলে সেখানে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানোই ছিল রেলপথ স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য।
  2. অর্থনৈতিক শোষণ: ইংল্যান্ডের কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (যেমন – তুলো, পাট) ভারতের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে বন্দরে পৌঁছে দেওয়া।
  3. বাজার দখল: বিলেতে তৈরি শিল্পপণ্য (যেমন – কাপড়) ভারতের বিভিন্ন বাজারে সহজে ছড়িয়ে দেওয়া।
  4. মূলধন বিনিয়োগ: ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতে রেলপথ নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করে উচ্চহারে মুনাফা (৫% সুদের গ্যারান্টি) অর্জন করতে চেয়েছিল।

ভারতের অর্থনীতিতে প্রভাব (সাহায্য?):

রেলপথ পরোক্ষভাবে ভারতের অর্থনীতিকে কিছুটা সাহায্য করেছিল (যেমন – যাতায়াত সহজ হয়, দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্যশস্য পাঠানো সম্ভব হয়)। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাবই ছিল বেশি।

  • রেলপথের মাধ্যমে সস্তা বিদেশি পণ্যে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়, যা ভারতের ‘অবশিল্পায়ন’-কে ত্বরান্বিত করে।
  • রেলপথ নির্মাণের সমস্ত যন্ত্রপাতি (লোহা, ইস্পাত, ইঞ্জিন) ব্রিটেন থেকে আসত, ফলে ভারতের নিজস্ব কোনো শিল্প এতে গড়ে ওঠেনি।
  • এর মাধ্যমে ‘সম্পদের বহির্গমন’ আরও সহজ হয়েছিল।

সুতরাং, রেলপথ মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থেই নির্মিত হয়েছিল, ভারতের উন্নতির জন্য নয়।

৮. ‘অবশিল্পায়ন’ বলতে কী বোঝো? ভারতের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের পিছনে কোম্পানির নীতিগুলি কীভাবে দায়ী ছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর:

অবশিল্পায়ন: ‘অবশিল্পায়ন’ কথার অর্থ হলো শিল্পের অবনতি বা ধ্বংস। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশ সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির ফলে ভারতের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পগুলি (বিশেষত তাঁত শিল্প) ধ্বংস হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ কারিগর বেকার হয়ে পড়ে। ভারতের এই শিল্প ধ্বংসের প্রক্রিয়াকেই ‘অবশিল্পায়ন’ বলা হয়।

কোম্পানির দায়ী নীতিগুলি:

  1. বৈষম্যমূলক শুল্কনীতি: ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি কাপড় ভারতে আমদানির ক্ষেত্রে নামমাত্র শুল্ক (কর) নিত, ফলে তা খুব সস্তা হতো। কিন্তু ভারতের তৈরি কাপড় ইংল্যান্ডে পাঠাতে গেলে তার ওপর ৭০% থেকে ৮০% পর্যন্ত চড়া শুল্ক বসানো হতো।
  2. কাঁচামাল রপ্তানি: কোম্পানি বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচা তুলো ও রেশম সস্তায় কিনে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিত। ফলে ভারতীয় তাঁতিদের চড়া দামে কাঁচামাল কিনতে হতো, যা তাদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিত।
  3. তাঁতিদের ওপর অত্যাচার: পলাশির যুদ্ধের পর কোম্পানি তাঁতিদের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তাদের সস্তায় নির্দিষ্ট পরিমাণে কাপড় বুনতে বাধ্য করা হতো (দাদন প্রথা)। রাজি না হলে তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার করা হতো।
  4. রেলপথের প্রভাব: রেলপথের মাধ্যমে বিলেতি সস্তা কাপড় ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও পৌঁছে যায়, ফলে স্থানীয় বাজারগুলিও ধ্বংস হয়ে যায়।

অধ্যায় ৫: সহযোগিতা ও বিদ্রোহ

৯. উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলির সীমাবদ্ধতা কী ছিল? কেন এই আন্দোলনগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি? [৫ নম্বর]

উত্তর: উনিশ শতকে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর বা ডিরোজিওর নেতৃত্বে যে সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তা যুগান্তকারী হলেও এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:

  1. শহর-কেন্দ্রিক: এই আন্দোলনগুলি মূলত কলকাতা, বোম্বাই বা মাদ্রাজের মতো বড় শহরগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামের বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে এই সংস্কারের বার্তা পৌঁছায়নি।
  2. শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিক: আন্দোলনগুলির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মূলত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, উচ্চবর্ণের (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ) এবং মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণী। কৃষিজীবী, শ্রমিক বা নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের সাথে এই আন্দোলনের সরাসরি যোগ ছিল না।
  3. শাস্ত্র-নির্ভরতা: সংস্কারকরা প্রায়শই কুসংস্কারের (যেমন সতীদাহ) বিরুদ্ধে মানবিক যুক্তির চেয়ে শাস্ত্রীয় যুক্তিকে (শাস্ত্রে কী লেখা আছে) বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এটি সাধারণ মানুষকে যুক্তিবাদী করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
  4. নিম্নবর্গকে উপেক্ষা: এই আন্দোলনগুলি মূলত উচ্চবর্ণের বিধবা বিবাহ বা সতীদাহ নিয়ে যতটা সোচ্চার ছিল, ততটা অস্পৃশ্যতা বা জাতিভেদ প্রথার মতো নিম্নবর্গের মানুষের সমস্যা নিয়ে ছিল না (ব্যতিক্রম – জ্যোতিরাও ফুলে)।
  5. ব্রিটিশ-নির্ভরতা: সংস্কারকরা সামাজিক আইন পাসের জন্য প্রায়শই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, যা তাদের আন্দোলনকে গণ-আন্দোলন হয়ে উঠতে বাধা দেয়।

এই কারণগুলির জন্যই সংস্কার আন্দোলনগুলি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, তা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি।

১০. সাঁওতাল বিদ্রোহ (হুল) এবং মুন্ডা বিদ্রোহ (উলগুলান) – এই দুটি উপজাতি বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা করো। [৫ নম্বর]

উত্তর: এই দুটি বিদ্রোহই ছিল ঔপনিবেশিক শোষণ ও বহিরাগতদের (‘দিকু’) বিরুদ্ধে উপজাতি সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ।

সাঁওতাল বিদ্রোহ (হুল – ১৮৫৫):

  • কারণ: সাঁওতালদের নিজস্ব বাসভূমি ‘দামিন-ই-কোহ’-তে বহিরাগত জমিদার, মহাজন (দিকু) ও ব্রিটিশ কর্মচারীদের শোষণ চরমে ওঠে। মহাজনরা চড়া সুদে ঋণ দিয়ে সাঁওতালদের জমি ও ফসল কেড়ে নিত। ব্রিটিশ আইন-আদালত ও পুলিশ দিকুদেরই পক্ষ নিত। এর প্রতিবাদে সিধু, কানহু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতালরা বিদ্রোহ (হুল) ঘোষণা করে।
  • গুরুত্ব: এই বিদ্রোহ এত তীব্র ছিল যে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে সাঁওতালদের জন্য ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করতে বাধ্য হয় এবং সেখানে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে।

মুন্ডা বিদ্রোহ (উলগুলান – ১৮৯৯):

  • কারণ: মুন্ডাদের ঐতিহ্যবাহী ‘খুৎকাঠি’ (জমির যৌথ মালিকানা) প্রথা ভেঙে দিয়ে ব্রিটিশরা জমিদার ও মহাজনদের হাতে জমি তুলে দেয়। মুন্ডাদের জোর করে ‘বেগার’ (বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম) খাটানো হতো।
  • নেতৃত্ব ও গুরুত্ব: বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (উলগুলান) শুরু করে। বিরসা মুন্ডা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘মুন্ডারাজ’ প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। এই বিদ্রোহের ফলেই ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ সালে ‘ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন’ পাস করে মুন্ডাদের জমির অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে এবং বেগার প্রথা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

১১. ‘বারাসাত বিদ্রোহ’ বা তিতুমিরের বিদ্রোহের (১৮৩১) প্রধান কারণগুলি কী ছিল? এর গুরুত্ব কী? [৫” নম্বর]

উত্তর:

কারণ:

  1. ধর্মীয় সংস্কার: তিতুমির ছিলেন ওয়াহাবি আদর্শে অনুপ্রাণিত। তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের ডাক দেন।
  2. জমিদারদের শোষণ: তিতুমিরের সংস্কার আন্দোলন স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের (বিশেষত পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়) স্বার্থে আঘাত করে। জমিদাররা তিতুমিরের অনুগামীদের ওপর ‘দাঁড়ির ওপর কর’ (Tax on Beard) এবং মসজিদের ওপর কর চাপান।
  3. নীলকরদের অত্যাচার: স্থানীয় নীলকর সাহেবরাও গরিব চাষিদের ওপর অত্যাচার চালাত, যা তিতুমিরকে ক্ষুব্ধ করে।

এই জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ প্রশাসনের মিলিত শোষণের বিরুদ্ধেই তিতুমির সাধারণ কৃষকদের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

গুরুত্ব:

তিতুমির বারাসাতের কাছে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে নিজেকে ‘বাদশাহ’ ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশ শাসনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানান। যদিও ব্রিটিশ কামানের মুখে এই কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিতুমির মারা যান, তবুও এই বিদ্রোহ ছিল বাংলার প্রথম সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম, যা পরবর্তী কৃষক আন্দোলনগুলিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

অধ্যায় ৬: জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক বিকাশ

১২. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে কি ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যুক্তিসঙ্গত? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও। [৫ নম্বর]

উত্তর: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।

  • ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলার কারণ: এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সিপাহিদের (এনফিল্ড রাইফেলের টোটা) ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের ফলে। বিদ্রোহ মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের সেনাছাউনিগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত এবং বাংলা ও পাঞ্জাব মূলত শান্ত ছিল।
  • ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলার কারণ:
    1. গণ-অংশগ্রহণ: এটি শুধু সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অযোধ্যা, বিহার, কানপুর, ঝাঁসির মতো জায়গায় লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ, কৃষক, কারিগর এই বিদ্রোহে যোগ দেন।
    2. ব্রিটিশ-বিরোধিতা: বিদ্রোহীদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘ফিরিঙ্গি’ বা ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করা। এটি ছিল ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ।
    3. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: এই বিদ্রোহে নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপি, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ-এর মতো হিন্দু নেতাদের পাশাপাশি বাহাদুর শাহ জাফর, বখত খানের মতো মুসলিম নেতারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন। বিদ্রোহীরা মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে ‘হিন্দুস্থানের সম্রাট’ ঘোষণা করেন, যা একটি অখণ্ড ভারতের ধারণাকে তুলে ধরে।

উপসংহার: যদিও এই বিদ্রোহের মধ্যে আধুনিক ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ধারণা স্পষ্ট ছিল না, তবুও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এর ব্যাপকতা, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার জন্য বিনায়ক দামোদর সাভারকর বা কার্ল মার্কসের মতো অনেকেই একে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন, যা অনেকাংশেই যুক্তিসঙ্গত।

১৩. ‘সভা-সমিতির যুগ’ বলতে কী বোঝো? এই প্রসঙ্গে ‘ভারত সভা’ (Indian Association)-র ভূমিকা আলোচনা করো। [৫ নম্বর]

উত্তর:

সভা-সমিতির যুগ: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকে ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত সময়কালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে (বিশেষত কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে) মূলত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী একাধিক রাজনৈতিক সভা-সমিতি গড়ে তোলে। যেমন – ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’, ‘জমিদার সভা’, ‘পুনা সার্বজনিক সভা’ ইত্যাদি। এই সমিতিগুলি সাংবিধানিক উপায়ে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করত। ভারতের রাজনীতিতে এই সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের সূচনাপর্বকে ঐতিহাসিক অনিল শীল ‘সভা-সমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

ভারত সভার ভূমিকা:

এই সমিতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সভা’ বা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। একে কংগ্রেসের পূর্বসূরি বলা হয়।

  • লক্ষ্য: এর লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র জমিদার বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নয়, বরং ‘জনগণকে’ (The People) ঐক্যবদ্ধ করা।
  • আন্দোলন: ভারত সভা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের বয়স কমানোর প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে।
  • অন্যান্য প্রতিবাদ: এটি ‘ইলবার্ট বিল’-এর পক্ষে এবং ‘অস্ত্র আইন’ ও ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন’-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

ভারত সভাই প্রথম একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল।

১৪. জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের (১৮৮৫-১৯০৫) নেতাদের ‘নরমপন্থী’ বলা হয় কেন? ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তাঁদের মনোভাব কেমন ছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর:

নরমপন্থী বলার কারণ:

১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ২০ বছরের নেতাদের (যেমন – সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নৌরজি, ফিরোজ শাহ মেহতা, গোপালকৃষ্ণ গোখলে) ‘নরমপন্থী’ (Moderates) বলা হয়। এর কারণ হলো:

  1. দাবি আদায়ের পদ্ধতি: তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান চাননি। তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকেই কিছু সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার আদায় করতে চেয়েছিলেন।
  2. কর্মসূচি: তাঁদের কর্মসূচি ছিল মূলত আবেদন-নিবেদন (Prayer, Petition) এবং প্রতিবাদের (Protest) মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁরা মনে করতেন, ব্রিটিশরা ন্যায়পরায়ণ, তাই যুক্তি দিয়ে বোঝালে তারা ভারতীয়দের দাবি মেনে নেবে। তাঁরা সরাসরি আন্দোলন বা বিদ্রোহের পথে যাননি।

ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মনোভাব:

নরমপন্থীরা ব্রিটিশ শাসনকে ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ’ (Divine Providence) বলে মনে করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশ শাসনের ফলেই ভারতে আধুনিকতার প্রসার ঘটছে, কুসংস্কার দূর হচ্ছে এবং একটি অখণ্ড ‘জাতি’ (Nation) গড়ে উঠছে। তাই তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ নয়, বরং ব্রিটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় থেকেই ভারতের স্বায়ত্তশাসনের (Self-Government) অধিকার দাবি করেছিলেন।

অধ্যায় ৭: ভারতের জাতীয় আন্দোলনের আদর্শ ও বিবর্তন

১৫. বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী (১৯০৫) আন্দোলনে ‘বয়কট’ ও ‘স্বদেশি’র গুরুত্ব কী ছিল? এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কী ছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক অজুহাতে বাংলাকে ভাগ করলে (বঙ্গভঙ্গ) তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার দুটি প্রধান কর্মসূচি ছিল ‘বয়কট’ ও ‘স্বদেশি’ (যাকে ‘স্বদেশি আন্দোলন’ বলা হয়)।

বয়কট ও স্বদেশির গুরুত্ব:

  1. বয়কট (Negative): এর অর্থ হলো ব্রিটিশ পণ্য, বিশেষত বিলেতি কাপড়, লবণ, চিনি এবং ব্রিটিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালত বর্জন করা। এটি ছিল ব্রিটিশ অর্থনীতির ওপর সরাসরি আঘাত।
  2. স্বদেশি (Constructive): বয়কটের ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণ করার জন্য ‘স্বদেশি’ বা দেশীয় পণ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। দেশীয় বস্ত্র কারখানা, সাবান, লবণ কারখানা এবং ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর অধীনে জাতীয় বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই আন্দোলনই প্রথম ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে আবেদন-নিবেদনের স্তর থেকে গণ-আন্দোলনের স্তরে পৌঁছে দেয়।

সীমাবদ্ধতা:

  • এই আন্দোলন মূলত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
  • আন্দোলনে হিন্দুধর্মীয় প্রতীক (যেমন – রাখিবন্ধন, কালীপূজা) ব্যবহারের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে তোলে।

১৬. গান্ধীজি কেন ‘অসহযোগ আন্দোলন’ (১৯২০) শুরু করেছিলেন? চৌরিচৌরার ঘটনার পর তিনি এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন কেন? [৫ নম্বর]

উত্তর:

অসহযোগ আন্দোলনের কারণ:

  1. রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ: ১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের মতো দমনমূলক আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ ছিল।
  2. খিলাফৎ সমস্যা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে ব্রিটিশরা তুরস্কের সুলতান বা ‘খলিফা’-র ক্ষমতা খর্ব করে। এতে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়। গান্ধীজি এই খিলাফৎ আন্দোলনকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখেন।
  3. স্বরাজ অর্জন: গান্ধীজি এই দুটি ইস্যুকে একত্রিত করে ব্রিটিশ সরকারের সাথে সমস্ত ‘অসহযোগিতা’ করে এক বছরের মধ্যে ‘স্বরাজ’ অর্জনের ডাক দেন।

আন্দোলন প্রত্যাহারের কারণ (চৌরিচৌরা):

আন্দোলন যখন চরমে, তখন ১৯২২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরা নামক স্থানে উত্তেজিত জনতা একটি পুলিশ থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়, যার ফলে ২২ জন পুলিশকর্মী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান।

গান্ধীজি ছিলেন অহিংসার পূজারী। এই হিংসাত্মক ঘটনায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং বুঝতে পারেন যে, দেশবাসী এখনও অহিংস আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত নয়। তাই তিনি একক সিদ্ধান্তে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।

১৭. ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে (১৯৪২) ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলা হয় কেন? এই আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা কেমন ছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর:

‘আগস্ট বিপ্লব’ বলার কারণ:

১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট বোম্বাইতে গান্ধীজি ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ (করব অথবা মরব) স্লোগান তুলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেন। ৯ই আগস্ট ভোরের আগেই ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজি সহ সমস্ত প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করে।

নেতাদের গ্রেপ্তারের ফলে এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের হাতে চলে যায় এবং এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ বা ‘বিপ্লব’-এর রূপ নেয়। জনতা সরকারি অফিস, রেললাইন, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। বাংলার তমলুক (মাতঙ্গিনী হাজরা), মহারাষ্ট্রের সাতারা সহ বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন ‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলনের বিপ্লবী রূপের জন্যই একে ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলা হয়।

নারীদের ভূমিকা:

এই আন্দোলনে নারীরা অভূতপূর্ব সাহসিকতার সাথে যোগ দেন।

  • মাতঙ্গিনী হাজরা: বাংলার তমলুকে থানা অভিযানের সময় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
  • অরুণা আসফ আলি: বোম্বাইতে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করেন এবং এরপর দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে আন্দোলন পরিচালনা করেন।
  • ঊষা মেহতা: বোম্বাইতে ‘আজাদ রেডিও’ নামে একটি গোপন বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে আন্দোলনের খবর প্রচার করতেন।
  • এ ছাড়াও সুচেতা কৃপালনি সহ অগণিত সাধারণ নারী এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৮. আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA) কীভাবে গঠিত হয়েছিল? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান কী? [৫ নম্বর]

উত্তর:

গঠন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে রাসবিহারী বসু ১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ (INA) গঠন করেন। পরের বছর (১৯৪৩) সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানি থেকে সিঙ্গাপুরে এসে এই বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সিঙ্গাপুরেই ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

অবদান:

  1. সামরিক অভিযান: সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানের সহায়তায় ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে ‘দিল্লি চলো’ ধ্বনি দিয়ে অভিযান শুরু করে। এই বাহিনী ইম্ফল ও কোহিমা পর্যন্ত দখল করে নেয় এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মুক্ত করে ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ নামকরণ করে।
  2. অনুপ্রেরণা: যদিও জাপানের পরাজয়ের পর এই অভিযান ব্যর্থ হয়, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ ভারতের সাধারণ মানুষ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবল দেশপ্রেমের সঞ্চার করে।
  3. ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি টলিয়ে দেওয়া: যুদ্ধের পর আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের বিচার (লালকেল্লা বিচার) শুরু হলে তার বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌ-সেনারা বিদ্রোহ (নৌবিদ্রোহ, ১৯৪৬) করে। ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে, ভারতীয় সেনারা আর অনুগত নেই। এই ঘটনাই ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে।

অধ্যায় ৮: সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশভাগ

১৯. ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী? মুসলিম লিগের ‘লাহোর প্রস্তাব’ (১৯৪০) কেন গুরুত্বপূর্ণ? [৫ নম্বর]

উত্তর:

দ্বিজাতি তত্ত্ব: ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ হলো একটি রাজনৈতিক মতবাদ যার মূল কথা হলো— ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রীতিনীতি সম্পূর্ণ আলাদা, তাই তারা কখনো এক হয়ে একটি অখণ্ড জাতি হিসেবে বাস করতে পারে না। মহম্মদ আলি জিন্নাহ ছিলেন এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা।

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব:

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে এই ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-এর ভিত্তিতেই ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ পাস হয়।

  • এই প্রস্তাবেই প্রথমবার মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলা হয়।
  • এতে বলা হয়, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” (Independent States) গঠন করতে হবে।
  • এই প্রস্তাবটিই পরবর্তীকালে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিতি পায়। এটি ছিল ভারত ভাগের পথে প্রথম আনুষ্ঠানিক ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে সম্পূর্ণ করে তোলে।

২০. ‘মন্ত্রী মিশন’ বা ‘ক্যাবিনেট মিশন’ (১৯৪৬)-এর প্রধান প্রস্তাবগুলি কী ছিল? এই মিশন কেন ব্যর্থ হয়েছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর:

প্রেক্ষাপট: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত জটিলতা কাটাতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় খুঁজতে তিনজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে (পেথিক লরেন্স, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এ. ভি. আলেকজান্ডার) ভারতে পাঠায়। এটিই ‘মন্ত্রী মিশন’ নামে পরিচিত।

প্রধান প্রস্তাব:

  1. অখণ্ড ভারত: মিশন মুসলিম লিগের পৃথক পাকিস্তানের দাবিকে নাকচ করে অখণ্ড ভারতের মধ্যেই একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের প্রস্তাব দেয়।
  2. দুর্বল কেন্দ্র: কেন্দ্র সরকারের হাতে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের দায়িত্ব থাকবে। বাকি সমস্ত ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতে থাকবে।
  3. প্রদেশগুলির গ্রুপিং: প্রদেশগুলিকে ‘ক’ (হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ), ‘খ’ (মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ, উত্তর-পশ্চিম) ও ‘গ’ (মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ, পূর্ব) —এই তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়।
  4. অন্তর্বর্তী সরকার: অবিলম্বে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগকে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

ব্যর্থতার কারণ:

কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ—উভয় দলই এই প্রস্তাবগুলির নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করে। কংগ্রেস ‘গ্রুপিং’ ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এবং মুসলিম লিগ মনে করে যে এই প্রস্তাবে পাকিস্তান না থাকায় তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। ফলে জিন্নাহ এই প্রস্তাব বর্জন করে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দেন এবং মিশন ব্যর্থ হয়।

২১. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (১৯৪৭) কী ছিল? এই পরিকল্পনার ফলস্বরূপ কীভাবে দেশভাগ হয়েছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর:

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা:

১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল হয়ে আসেন। তিনি ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে বুঝতে পারেন যে, অখণ্ড ভারত রক্ষা করা আর সম্ভব নয়।

তাই তিনি ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ভারত ভাগের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ বা ‘৩রা জুন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।

দেশভাগ:

এই পরিকল্পনায় বলা হয়:

  1. ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি পৃথক ডোমিনিয়ন বা রাষ্ট্র তৈরি করা হবে।
  2. বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ দুটিকেও ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করা হবে (পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ; পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব পাঞ্জাব)।
  3. আসামের শ্রীহট্ট (সিলেট) জেলায় এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোটের মাধ্যমে স্থির করা হবে তারা কোন রাষ্ট্রে যোগ দেবে।
  4. দেশীয় রাজ্যগুলিকে (যেমন কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ) ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালের ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’ পাস হয় এবং ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্ট ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

অধ্যায় ৯: ভারতীয় সংবিধান

২২. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble) উল্লিখিত ‘সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র’ কথাগুলির অর্থ ব্যাখ্যা করো। [৫ নম্বর]

উত্তর: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা হলো সংবিধানের ‘মুখবন্ধ’ বা ‘আয়না’, যা সংবিধানের মূল দর্শনকে তুলে ধরে। এতে ভারতকে যে আদর্শে গড়ার কথা বলা হয়েছে তা হলো:

  1. সার্বভৌম (Sovereign): এর অর্থ ভারত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক—উভয় ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ স্বাধীন। ভারত নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, কোনো বিদেশি শক্তি তার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
  2. সমাজতান্ত্রিক (Socialist): (এটি ১৯৭৬ সালে যুক্ত হয়) এর লক্ষ্য হলো গণতান্ত্রিক উপায়ে আয়ের বৈষম্য কমানো, সম্পদের সুষম বণ্টন করা এবং এক শোষণমুক্ত সমাজ গড়া।
  3. ধর্মনিরপেক্ষ (Secular): (এটিও ১৯৭৬ সালে যুক্ত হয়) এর অর্থ হলো রাষ্ট্রের কোনো নিজস্ব ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমান চোখে দেখবে এবং নাগরিকরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে।
  4. গণতান্ত্রিক (Democratic): এর অর্থ ভারতের শাসনব্যবস্থা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ, সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
  5. সাধারণতন্ত্র (Republic): এর অর্থ ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রপতি) বংশানুক্রমিক রাজা বা রানি নন, তিনি জনগণের দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন।

২৩. ভারতের সংবিধানের ৬টি মৌলিক অধিকার কী কী? এর মধ্যে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার’-কে ডঃ আম্বেদকর ‘সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা’ বলেছেন কেন? [৫ নম্বর]

উত্তর:

৬টি মৌলিক অধিকার:

ভারতের সংবিধান দেশের নাগরিকদের ৬টি প্রধান মৌলিক অধিকার দিয়েছে:

  1. সাম্যের অধিকার (আইনের চোখে সবাই সমান)।
  2. স্বাধীনতার অধিকার (কথা বলা, মতামত প্রকাশ, বসবাস করার স্বাধীনতা)।
  3. শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার (বেগার খাটানো বা শিশুশ্রম নিষিদ্ধ)।
  4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম পালনের অধিকার)।
  5. সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার (ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার)।
  6. সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার (অধিকার খর্ব হলে আদালতে যাওয়ার অধিকার)।

‘সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা’ বলার কারণ:

সংবিধানের খসড়া কমিটির সভাপতি ডঃ বি. আর. আম্বেদকর ৬ নম্বর অধিকারটিকে অর্থাৎ ‘সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার’-কে (Article 32) ‘সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা’ (Heart and Soul of the Constitution) বলে অভিহিত করেছেন।

কারণ, প্রথম ৫টি অধিকার কেবল কাগজে-কলমে লেখা থাকলে তার কোনো মূল্য থাকত না, যদি না সেগুলি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা থাকত। এই ৬ নম্বর অধিকারটিই হলো সেই রক্ষাকবচ। যদি রাষ্ট্র বা কোনো ব্যক্তি নাগরিকের অন্য কোনো মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, তবে নাগরিক এই অধিকারের বলেই সরাসরি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে বিচার চাইতে পারে। আদালত তখন ‘লেখ’ (Writ) জারি করে সেই অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ, এই অধিকারটিই অন্য অধিকারগুলিকে জীবন্ত ও অর্থপূর্ণ করে তুলেছে, তাই এটি সংবিধানের ‘হৃদয় ও আত্মা’।

২৪. ‘মৌলিক কর্তব্য’ (Fundamental Duties) এবং ‘রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি’ (Directive Principles)-র মধ্যে পার্থক্য কী? [৫ নম্বর]

উত্তর: ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার ছাড়াও এই দুটি বিষয় রয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলি হলো:

  1. উদ্দেশ্য:
    • নির্দেশমূলক নীতি: এগুলি হলো রাষ্ট্রের প্রতি সংবিধানের নির্দেশ বা পরামর্শ। রাষ্ট্র আইন বা নীতি তৈরি করার সময় এই আদর্শগুলি (যেমন – গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন, অবৈতনিক শিক্ষা, সম্পদের সুষম বণ্টন) মাথায় রেখে চলবে। এর লক্ষ্য একটি ‘কল্যাণকামী রাষ্ট্র’ (Welfare State) গঠন করা।
    • মৌলিক কর্তব্য: এগুলি হলো দেশের প্রতি নাগরিকদের দায়িত্ব (যেমন – সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে সম্মান করা, জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা)। এর লক্ষ্য নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা।
  2. বাধ্যবাধকতা (প্রধান পার্থক্য):
    • নির্দেশমূলক নীতি: এগুলি আইনত বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ, সরকার এই নীতিগুলি পালন না করলে নাগরিক আদালতে বিচার চাইতে পারে না।
    • মৌলিক কর্তব্য: এগুলিও আইনত বাধ্যতামূলক নয় (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। অর্থাৎ, কোনো নাগরিক এই কর্তব্য পালন না করলে (যেমন জাতীয় পতাকাকে সম্মান না করা) কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি হতে পারে, তবে বেশিরভাগ কর্তব্যই হলো নীতিগত।
  3. প্রয়োগ: নির্দেশমূলক নীতি প্রয়োগ করে রাষ্ট্র, আর মৌলিক কর্তব্য পালন করে নাগরিক।

২৫. ‘সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার’ বলতে কী বোঝো? এটি ভারতের গণতন্ত্রকে কীভাবে শক্তিশালী করেছে? [৫ নম্বর]

উত্তর:

সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার:

ভারতীয় সংবিধানের ৩২৬ নং ধারা অনুযায়ী, ‘সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার’ (Universal Adult Franchise) স্বীকৃত হয়েছে। এর অর্থ হলো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে, দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক (যাদের বয়স বর্তমানে ১৮ বছর বা তার বেশি) নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার পাবেন।

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ভূমিকা:

  1. রাজনৈতিক সাম্য: এই অধিকার ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষর, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়েছে। আম্বানি বা টাটার ভোটের যা মূল্য, একজন দিনমজুরের ভোটের মূল্যও তাই।
  2. জনগণের সরকার: এর মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই নিজেদের শাসক নির্বাচন করতে পারে। সরকার যদি জনস্বার্থে কাজ না করে, তবে পরের নির্বাচনে জনগণ ভোট না দিয়ে সেই সরকারকে সরিয়ে দিতে পারে।
  3. দায়বদ্ধতা: এই ব্যবস্থার ফলে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়।
  4. অংশগ্রহণ: এটি দেশের আপামর জনসাধারণকে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে, যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।

এইভাবেই ভোটাধিকার ভারতের গণতন্ত্রকে বিশ্বের বৃহত্তম এবং শক্তিশালী গণতন্ত্রে পরিণত করেছে।

২৬. ভারতীয় গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ (আইন, শাসন, বিচার) কীভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং কীভাবে তারা একে অপরের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে? [৫ নম্বর]

উত্তর: ভারতীয় গণতন্ত্র তিনটি প্রধান স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে:

  1. আইন বিভাগ (Legislature): সংসদ (লোকসভা, রাজ্যসভা) – এর কাজ আইন তৈরি করা।
  2. শাসন বিভাগ (Executive): রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা – এর কাজ সেই আইনকে প্রয়োগ বা বাস্তবায়িত করা।
  3. বিচার বিভাগ (Judiciary): সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট – এর কাজ সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা করা এবং বিরোধের নিষ্পত্তি করা।

পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ (Checks and Balances):

এই তিনটি বিভাগ স্বাধীন হলেও, কেউ যেন স্বৈরাচারী হয়ে না ওঠে, তাই সংবিধান একে অপরের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রেখেছে:

  • শাসন বিভাগের ওপর আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ: শাসন বিভাগ বা মন্ত্রিসভাকে তার কাজের জন্য আইন বিভাগ বা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। সংসদ ‘অাস্থা ভোট’-এর মাধ্যমে মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করতে পারে।
  • আইন বিভাগের ওপর বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ: সংসদ যদি এমন কোনো আইন পাস করে যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে, তবে বিচার বিভাগ (সুপ্রিম কোর্ট) সেই আইনকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে বাতিল করে দিতে পারে (Judicial Review)।
  • বিচার বিভাগের ওপর আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ: রাষ্ট্রপতি (শাসন বিভাগ) সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। আবার সংসদ (আইন বিভাগ) ‘ইমপিচমেন্ট’ পদ্ধতির মাধ্যমে বিচারপতিদের পদচ্যুত করতে পারে।

এই পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu