চূড়ান্ত প্রকল্প নোটস: অতীত ও ঐতিহ্য (সম্পূর্ণ বই)
প্রসেসিং…

বিষয়: অতীত ও ঐতিহ্য (অষ্টম শ্রেণি)

চূড়ান্ত প্রকল্প নোটস (সম্পূর্ণ বই)

অধ্যায় ১: ইতিহাসের ধারণা

১. ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ও ‘উপনিবেশবাদ’-এর সম্পর্ক কী? [৩ নম্বর]

উত্তর: ‘সাম্রাজ্যবাদ’ একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র অন্য দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে তার সম্পদ দখল করে। ‘উপনিবেশবাদ’ হলো এই সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়নের কৌশল।

যখন কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্য কোনো দুর্বল দেশকে দখল করে এবং সেই দেশের জনগণ ও সম্পদকে নিজের দেশের স্বার্থে ব্যবহার করে, তখন দখলীকৃত দেশটি মূল দেশটির ‘উপনিবেশে’ পরিণত হয়। যেমন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তাই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

২. জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে কীভাবে ভাগ করেছেন? এই বিভাজনে সমস্যা কী? [৫ নম্বর] [গুরুত্বপূর্ণ]

উত্তর:

জেমস মিলের যুগ বিভাজন:

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস মিল তাঁর ‘History of British India’ গ্রন্থে ভারতের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করেন:

  1. হিন্দু যুগ
  2. মুসলিম যুগ
  3. ব্রিটিশ যুগ

সমস্যা:

  • সাম্প্রদায়িক: এই বিভাজনটি শাসকের ধর্মের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক। একটি যুগের পরিচয় শুধু শাসকের ধর্ম দিয়ে হতে পারে না।
  • অসম্পূর্ণ: প্রাচীন ভারতে শুধু হিন্দু শাসক ছিলেন না, বৌদ্ধ (যেমন অশোক) বা জৈন শাসকরাও ছিলেন। মধ্যযুগেও অনেক হিন্দু শাসক ছিলেন।
  • উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: মিল দেখাতে চেয়েছিলেন যে, হিন্দু ও মুসলিম যুগ ছিল ‘অন্ধকারময়’ এবং ব্রিটিশ যুগই ভারতে ‘আধুনিকতা’ এনেছে। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে একটি যুক্তি তৈরি করার চেষ্টা।
  • ভুল ধারণা: প্রাচীন যুগকে ‘হিন্দু যুগ’ এবং মধ্যযুগকে ‘মুসলিম যুগ’ বললে এই ভুল ধারণা তৈরি হয় যে সেই যুগের সমস্ত মানুষই বুঝি ওই ধর্মের ছিলেন, যা সত্য নয়।

অধ্যায় ২: আঞ্চলিক শক্তির উত্থান

৩. ‘ফাররুখশিয়রের ফরমান’ (১৭১৭) কী ছিল? [৩ নম্বর]

উত্তর: ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়র ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটি আদেশ বা ‘ফরমান’ জারি করেন।

এই ফরমান অনুযায়ী, কোম্পানি বছরে মাত্র ৩,০০০ টাকার বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার পায়। কোম্পানিকে কলকাতার আশেপাশে ৩৮টি গ্রাম কেনার অনুমতি দেওয়া হয় এবং কোম্পানির নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। এই ফরমান বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়াতে enormously সাহায্য করেছিল।

৪. পলাশির যুদ্ধ (১৭৫৭) ও বক্সারের যুদ্ধের (১৭৬৪) মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? [৫ নম্বর] [গুরুত্বপূর্ণ]

উত্তর: পলাশির যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের তুলনা করলে **বক্সারের যুদ্ধ** ভারতে কোম্পানির ক্ষমতা বিস্তারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

  • পলাশির যুদ্ধ: এটি ছিল মূলত একটি যুদ্ধের প্রহসন। এটি বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে জেতা একটি যুদ্ধ (মীরজাফর, জগৎ শেঠদের বিশ্বাসঘাতকতা)। এর ফলে শুধু বাংলায় কোম্পানির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হন।
  • বক্সারের যুদ্ধ: এটি ছিল একটি সত্যিকারের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ কোম্পানি একা তিনটি প্রধান ভারতীয় শক্তিকে—বাংলার নবাব মীরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম—একসাথে পরাজিত করে।
  • গুরুত্ব: এই যুদ্ধের ফলে ১৭৬৫ সালে কোম্পানি ‘দেওয়ানি’ (রাজস্ব আদায়ের অধিকার) লাভ করে। এর মাধ্যমে বাংলার উপর কোম্পানির আইনি ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সমগ্র উত্তর ভারতে কোম্পানির সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। তাই বক্সারের যুদ্ধই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

৫. ‘দেওয়ানি লাভ’ (১৭৬৫) ও ‘দ্বৈত শাসন’ বলতে কী বোঝো? [৫ নম্বর]

উত্তর:

দেওয়ানি লাভ: ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর, ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেন। এই ঘটনা ‘দেওয়ানি লাভ’ নামে পরিচিত।

দ্বৈত শাসন (Dual System): দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা চালু হয়, যা ‘দ্বৈত শাসন’ নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায়:

  1. কোম্পানির হাতে ক্ষমতা: কোম্পানি ‘দেওয়ান’ হিসেবে রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে রাখে। অর্থাৎ, কোম্পানির হাতে ছিল ‘দায়িত্বহীন ক্ষমতা’।
  2. নবাবের হাতে দায়িত্ব: অন্যদিকে, বাংলার নবাবের হাতে রইল দেশশাসন ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব (নিজামত)। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল না। অর্থাৎ, নবাবের হাতে ছিল ‘ক্ষমতাহীন দায়িত্ব’।

এই ব্যবস্থার ফলে বাংলায় চূড়ান্ত অরাজকতা ও শোষণ দেখা দেয়, যার ভয়াবহ পরিণতি ছিল ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ)।

অধ্যায় ৩: ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা

৬. ‘কর্ণওয়ালিস কোড’ (১৭৯৩) কী? [২ নম্বর]

উত্তর: লর্ড কর্নওয়ালিস কোম্পানির প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং শাসন, বিচার ও রাজস্ব বিভাগকে আলাদা করতে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কিছু നിയമ-কানুন বা বিধি চালু করেন। এটি ‘কর্ণওয়ালিস কোড’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা ও রাজস্ব আদায়ের কাজকে পৃথক করা হয়েছিল এবং প্রশাসনের ইউরোপীয়করণ করা হয়েছিল।

৭. ‘অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি’ ও ‘স্বত্ববিলোপ নীতি’ কী ছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: এই দুটি নীতি ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের দুটি প্রধান কৌশল।

  • অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি (Subsidiary Alliance): লর্ড ওয়েলেসলি এই নীতি চালু করেন। এই নীতি গ্রহণ করলে কোনো দেশীয় রাজ্যকে কোম্পানির অনুমতি ছাড়া অন্য রাজ্যের সাথে যুদ্ধ বা মিত্রতা করা থেকে বিরত থাকতে হতো। সেই রাজ্যে একদল ব্রিটিশ সৈন্য রাখতে হতো এবং সেই সৈন্যের খরচের জন্য নগদ টাকা বা রাজ্যের একাংশ কোম্পানিকে ছেড়ে দিতে হতো। এর বিনিময়ে কোম্পানি সেই রাজ্যকে ‘রক্ষা’ করার প্রতিশ্রুতি দিত। হায়দ্রাবাদের নিজাম প্রথম এই নীতি গ্রহণ করেন।
  • স্বত্ববিলোপ নীতি (Doctrine of Lapse): লর্ড ডালহৌসি এই নীতি প্রয়োগ করেন। এই নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্রিটিশ-আশ্রিত দেশীয় রাজ্যের রাজা যদি পুত্রসন্তান ছাড়া মারা যেতেন, তবে সেই রাজ্যের দত্তকপুত্রের উত্তরাধিকারকে কোম্পানি স্বীকৃতি দিত না। সেই রাজ্যটি সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে যেত। এই নীতির মাধ্যমে ঝাঁসি, সাতারা, নাগপুর ইত্যাদি রাজ্য দখল করা হয়েছিল।

অধ্যায় ৪: ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র

৮. ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ (১৭৯৩) কেন প্রবর্তন করা হয়? [৩ নম্বর]

উত্তর: লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করেন। এর কারণ:

  1. নির্দিষ্ট রাজস্ব: এর মাধ্যমে কোম্পানি জমিদারদের কাছ থেকে বার্ষিক কত রাজস্ব পাবে তা চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ফলে কোম্পানির আয় সুনিশ্চিত হয়।
  2. অনুগত গোষ্ঠী তৈরি: জমিদারদের জমির ওপর স্থায়ী মালিকানা দিয়ে কোম্পানি নিজের পক্ষে একটি অনুগত ও শক্তিশালী শ্রেণী তৈরি করতে চেয়েছিল, যারা ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
  3. কৃষির উন্নতি (আশা): কোম্পানি আশা করেছিল যে, জমির মালিকানা স্থায়ী হলে জমিদাররা কৃষির উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করবে (যদিও বাস্তবে তা হয়নি)।

৯. ‘অবশিল্পায়ন’ বলতে কী বোঝো? [৩ নম্বর]

উত্তর: ‘অবশিল্পায়ন’ কথার অর্থ হলো শিল্পের অবনতি বা ধ্বংস। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশ সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্কনীতির ফলে ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি সস্তা পণ্যে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়। অন্যদিকে, ভারতের তৈরি কাপড়ের ওপর ব্রিটেনে উচ্চহারে কর বসানো হয়।

এর ফলে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ভারতের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পগুলি (বিশেষত তাঁত শিল্প) ধ্বংস হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ কারিগর বেকার হয়ে পড়ে। ভারতের এই শিল্প ধ্বংসের প্রক্রিয়াকেই ‘অবশিল্পায়ন’ বলা হয়।

১০. ‘সম্পদের বহির্গমন’ (Drain of Wealth) কাকে বলে? [৩ নম্বর]

উত্তর: পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং তার কর্মচারীরা নানা উপায়ে (যেমন – রাজস্ব আদায়, সস্তায় পণ্য কেনা, ঘুষ, বেআইনি বাণিজ্য) ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ব্রিটেনে পাঠাতে শুরু করে।

এইভাবে ভারতের সম্পদ ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তার বিনিময়ে ভারত অর্থনৈতিকভাবে কিছুই পাচ্ছিল না। দাদাভাই নৌরজি এই প্রক্রিয়াকে ‘সম্পদের বহির্গমন’ বলে অভিহিত করেছেন। এই সম্পদ নির্গমনই ছিল ভারতের দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ।

অধ্যায় ৫: সহযোগিতা ও বিদ্রোহ

১১. সতীদাহ প্রথা রদ (১৮২৯) এবং বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬) প্রচলনে কাদের ভূমিকা ছিল? [৩ নম্বর]

উত্তর:

  • সতীদাহ প্রথা রদ: রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জোরালো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, এই প্রথা অমানবিক এবং শাস্ত্রসম্মত নয়। তাঁর এই আন্দোলনের ফলে গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আইন করে সতীদাহ প্রথা রদ বা নিষিদ্ধ করেন।
  • বিধবা বিবাহ আইন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের সমর্থনে শাস্ত্রীয় যুক্তি তুলে ধরেন এবং এর স্বপক্ষে প্রবল আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির আমলে (এবং লর্ড ক্যানিং-এর সময়) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়।

১২. সাঁওতাল বিদ্রোহ (হুল) (১৮৫৫) এবং মুন্ডা বিদ্রোহ (উলগুলান) (১৮৯৯) কেন হয়েছিল? [৫ নম্বর]

উত্তর: এই দুটি বিদ্রোহই ছিল ঔপনিবেশিক শোষণ ও বহিরাগতদের (‘দিকু’) বিরুদ্ধে উপজাতি সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ।

সাঁওতাল বিদ্রোহ (হুল):

  • কারণ: সাঁওতালদের ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রান্তদেশ) অঞ্চলে বহিরাগত জমিদার, মহাজন (দিকু) ও ব্রিটিশ কর্মচারীদের শোষণ চরমে ওঠে। মহাজনরা চড়া সুদে ঋণ দিয়ে সাঁওতালদের জমি কেড়ে নিত। ব্রিটিশ আইন-আদালতও দিকুদের পক্ষ নিত।
  • নেতৃত্ব: সিধু, কানহু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (হুল) ঘোষণা করে।

মুন্ডা বিদ্রোহ (উলগুলান):

  • কারণ: মুন্ডাদের ঐতিহ্যবাহী ‘খুৎকাঠি’ (জমির যৌথ মালিকানা) প্রথা ভেঙে দিয়ে ব্রিটিশরা জমিদার ও মহাজনদের হাতে জমি তুলে দেয়। মুন্ডাদের জোর করে ‘বেগার’ (বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম) খাটানো হতো।
  • নেতৃত্ব: বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (উলগুলান বা ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা) শুরু করে। বিরসা মুন্ডা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘মুন্ডারাজ’ প্রতিষ্ঠার ডাক দেন।

অধ্যায় ৬: জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক বিকাশ

১৩. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে (মহাবিদ্রোহ) কি ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলা যায়? [৫ নম্বর]

উত্তর: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।

  • সিপাহি বিদ্রোহ: প্রাথমিকভাবে এটি ছিল এনফিল্ড রাইফেলের টোটা সংক্রান্ত ধর্মীয় গুজবের বিরুদ্ধে সিপাহিদের বিদ্রোহ।
  • গণবিদ্রোহ: কিন্তু দ্রুতই এই বিদ্রোহে উত্তর ও মধ্য ভারতের বহু সাধারণ মানুষ, কৃষক, কারিগর এবং ক্ষমতাচ্যুত জমিদার ও রাজারা (যেমন – নানা সাহেব, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ) যোগ দেন। তাঁরা ব্রিটিশ শাসন, শোষণ ও স্বত্ববিলোপ নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন।
  • জাতীয় বিদ্রোহ কেন বলা হয়: এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য লড়াই করেছিল এবং মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ‘হিন্দুস্থানের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেছিল। ব্রিটিশ-বিরোধী এই ঐক্যবদ্ধ রূপের জন্যই অনেক ঐতিহাসিক (যেমন – কার্ল মার্কস, বিনায়ক দামোদর সাভারকর) একে ভারতের ‘প্রথম জাতীয় বিদ্রোহ’ বা ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন।

সুতরাং, এই বিদ্রোহ সিপাহিদের মাধ্যমে শুরু হলেও এটি দ্রুত গণবিদ্রোহের রূপ নেয় এবং এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের উপাদানও স্পষ্ট ছিল।

১৪. ‘সভা-সমিতির যুগ’ (১৮৫৭-১৮৮৫) বলতে কী বোঝো? [৩ নম্বর]

উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর থেকে ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত সময়কালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে (বিশেষত কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে) একাধিক রাজনৈতিক সভা-সমিতি গড়ে ওঠে। যেমন – ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’, ‘জমিদার সভা’, ‘ভারত সভা’, ‘পুনা সার্বজনিক সভা’ ইত্যাদি।

এই সমিতিগুলি মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের দাবি-দাওয়া (যেমন – সরকারি চাকরিতে ভারতীয়দের নিয়োগ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, কর হ্রাস) নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করত। ভারতের রাজনীতিতে এই সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের সূচনাকে ঐতিহাসিকরা ‘সভা-সমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

অধ্যায় ৭: ভারতের জাতীয় আন্দোলনের আদর্শ ও বিবর্তন

১৫. রাওলাট সত্যাগ্রহ (১৯১৯) এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ? [৫ নম্বর] [গুরুত্বপূর্ণ]

উত্তর:

রাওলাট সত্যাগ্রহ: ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘রাওলাট আইন’ পাস করে, যার দ্বারা যেকোনো ভারতীয়কে বিনা বিচারে গ্রেপ্তার করা যেত। গান্ধীজি এই ‘কালা কানুন’-এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অহিংস প্রতিবাদের (সত্যাগ্রহ) ডাক দেন। এটিই ছিল গান্ধীজির প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন। এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধীজি জাতীয় আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড: রাওলাট আইনের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি শান্তিপূর্ণ সভায় জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। শত শত মানুষ নিহত হন।

গুরুত্ব: এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের সমস্ত মোহভঙ্গ করে দেয়। এর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গান্ধীজি ‘অসহযোগ আন্দোলন’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত করে।

১৬. ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন (১৯৪২)-কে ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলা হয় কেন? [৩ নম্বর]

উত্তর: ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট গান্ধীজি ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ (করব অথবা মরব) স্লোগান তুলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেন। ৯ই আগস্ট ভোরের আগেই ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজি সহ সমস্ত প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করে।

নেতাদের গ্রেপ্তারের ফলে এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের হাতে চলে যায় এবং স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহে পরিণত হয়। জনতা সরকারি অফিস, রেললাইন, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। বাংলার তমলুক সহ বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন ‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলনের বিপ্লবী রূপের জন্যই একে ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলা হয়।

অধ্যায় ৮: সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশভাগ

১৭. ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (১৯৪৬) কী? এর ফলাফল কী হয়েছিল? [৩ নম্বর]

উত্তর:

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস: ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬) অখণ্ড ভারতের প্রস্তাব দিলে এবং পৃথক পাকিস্তানের দাবি অগ্রাহ্য করলে, মুসলিম লিগ নেতা জিন্নাহ ক্ষুব্ধ হন। তিনি পাকিস্তান আদায়ের জন্য ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দেন এবং ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা করেন।

ফলাফল: ওই দিন কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় (‘The Great Calcutta Killings’)। এই দাঙ্গায় হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান নিহত হন। এই হিংসা নোয়াখালি ও বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। এই ভয়াবহ রক্তপাত দেশভাগকে প্রায় অনিবার্য করে তোলে।

১৮. ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ (১৯৪৭) কী ছিল? [৩ নম্বর]

উত্তর: ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারেন যে, হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামিয়ে অখণ্ড ভারত বজায় রাখা অসম্ভব। তাই ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন তিনি ভারত-ভাগের একটি পরিকল্পনা পেশ করেন, যা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।

এই পরিকল্পনায় বলা হয়:

  1. ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করা হবে।
  2. বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকেও ধর্মীয় ভিত্তিতে ভাগ করা হবে।
  3. এর ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’ পাস হয়।

অধ্যায় ৯: ভারতীয় সংবিধান

১৯. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার (Preamble) মূল আদর্শগুলি কী কী? [৫ নম্বর] [গুরুত্বপূর্ণ]

উত্তর: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতের যে মূল আদর্শগুলির কথা বলা হয়েছে, সেগুলি হলো:

  1. সার্বভৌম: ভারত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
  2. সমাজতান্ত্রিক: গণতান্ত্রিক উপায়ে সম্পদের সুষম বণ্টন ও অসাম্য দূর করা রাষ্ট্রের লক্ষ্য।
  3. ধর্মনিরপেক্ষ: রাষ্ট্রের কোনো নিজস্ব ধর্ম নেই, সকল ধর্মই সমান।
  4. গণতান্ত্রিক: দেশের শাসনভার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকবে।
  5. সাধারণতন্ত্র: দেশের রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রপতি) বংশানুক্রমিক নন, তিনি নির্বাচিত।

২০. ভারতীয় সংবিধানের প্রধান মৌলিক অধিকারগুলি কী কী? [৫ নম্বর]

উত্তর: ভারতের সংবিধান দেশের নাগরিকদের ৬টি প্রধান মৌলিক অধিকার দিয়েছে:

  1. সাম্যের অধিকার (আইনের চোখে সবাই সমান)।
  2. স্বাধীনতার অধিকার (কথা বলা, মতামত প্রকাশ, বসবাস করার স্বাধীনতা)।
  3. শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার (বেগার খাটানো বা শিশুশ্রম নিষিদ্ধ)।
  4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম পালনের অধিকার)।
  5. সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার (ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার)।
  6. সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার (অধিকার খর্ব হলে আদালতে যাওয়ার অধিকার)।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu