প্রকল্প পত্র: ভারতীয় সংবিধান
প্রসেসিং…

বিষয়: অতীত ও ঐতিহ্য

অধ্যায় ৯: ভারতীয় সংবিধান: গণতন্ত্রের কাঠামো ও জনগণের অধিকার (প্রকল্প নোটস)

মূল ধারণা ও প্রশ্নাবলী

১. সংবিধান কী? [২ নম্বর]

উত্তর: ‘সংবিধান’ হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নিয়ম-কানুন বা আইনের সমষ্টি। এটি একটি লিখিত দলিল (কিছু ক্ষেত্রে অলিখিতও হতে পারে), যা একটি দেশের সরকার কীভাবে গঠিত হবে, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের (আইন, শাসন, বিচার) ক্ষমতা কী হবে এবং নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যগুলি কী—তা নির্দিষ্ট করে দেয়।

২. ‘গণপরিষদ’ কেন গঠিত হয়েছিল? [২ নম্বর]

উত্তর: ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দেশের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই সংবিধান রচনার মহান দায়িত্ব পালনের জন্যই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘গণপরিষদ’ (Constituent Assembly) গঠন করা হয়েছিল।

৩. ভারতের সংবিধান রচনায় ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের ভূমিকা কী ছিল? [৩ নম্বর]

উত্তর: ডঃ বি. আর. আম্বেদকর ছিলেন ভারতীয় সংবিধানের ‘খসড়া কমিটি’ (Drafting Committee)-র সভাপতি। তাঁর সভাপতিত্বে এই কমিটি সংবিধানের মূল কাঠামোটি তৈরি করে। সংবিধানের প্রতিটি ধারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা, বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে উৎকৃষ্ট বিষয়গুলি গ্রহণ করা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণাটি সংবিধানে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক। এই কারণেই তাঁকে ‘ভারতীয় সংবিধানের জনক’ বলা হয়।

৪. ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ (Republic Day) কবে এবং কেন পালন করা হয়? [৩ নম্বর]

উত্তর: ভারতের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর। কিন্তু এই সংবিধানকে কার্যকর করা হয় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি। ওই দিন থেকেই ভারত একটি ‘সাধারণতন্ত্র’ বা ‘প্রজাতান্ত্রিক’ (Republic) রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই প্রতি বছর ২৬শে জানুয়ারি ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ পালন করা হয়।

৫. ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল আদর্শগুলি কী কী? [৫ নম্বর] [গুরুত্বপূর্ণ]

উত্তর: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble) ভারতের যে মূল আদর্শগুলির কথা বলা হয়েছে, সেগুলি হলো:

  1. সার্বভৌম (Sovereign): ভারত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক—উভয় ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ স্বাধীন। কোনো বিদেশি শক্তি ভারতের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
  2. সমাজতান্ত্রিক (Socialist): ভারতের লক্ষ্য হলো গণতান্ত্রিক উপায়ে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং অসাম্য দূর করে এক শোষণমুক্ত সমাজ গড়া।
  3. ধর্মনিরপেক্ষ (Secular): রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না এবং কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না। রাষ্ট্রের চোখে সব ধর্ম সমান এবং নাগরিকরা নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীন।
  4. গণতান্ত্রিক (Democratic): ভারতের শাসনব্যবস্থা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
  5. সাধারণতন্ত্র (Republic): ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রপতি) বংশানুক্রমিক রাজা বা রানি নন, তিনি জনগণের দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন।

৬. গণতন্ত্রের তিনটি প্রধান স্তম্ভ কী কী? সংক্ষেপে তাদের কাজ লেখো। [৫ নম্বর] [গুরুত্বপূর্ণ]

উত্তর: ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান তিনটি স্তম্ভ হলো:

  1. আইন বিভাগ (Legislature): এর প্রধান কাজ হলো দেশের জন্য আইন তৈরি করা বা পুরোনো আইনের সংশোধন করা। কেন্দ্রীয় স্তরে এটি হলো সংসদ (লোকসভা ও রাজ্যসভা) এবং রাজ্য স্তরে এটি বিধানসভা।
  2. শাসন বিভাগ (Executive): এর প্রধান কাজ হলো সংসদের তৈরি করা আইনগুলিকে বাস্তবায়িত করা বা কার্যকর করা এবং দেশের প্রশাসন পরিচালনা করা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা এই বিভাগের অংশ।
  3. বিচার বিভাগ (Judiciary): এর প্রধান কাজ হলো সংবিধানের ব্যাখ্যা করা, আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি দেওয়া এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত এই বিভাগের অংশ।
গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ ভারতীয় সংবিধান আইন বিভাগ কাজ: আইন তৈরি করা শাসন বিভাগ কাজ: আইন প্রয়োগ করা বিচার বিভাগ কাজ: আইন রক্ষা করা

চিত্র: গণতন্ত্রের তিনটি প্রধান স্তম্ভ।

৭. ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বলতে কী বোঝো? [৩ নম্বর]

উত্তর: ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র। এর অর্থ হলো, এখানে একটি কেন্দ্রীয় সরকার (সমস্ত দেশের জন্য) এবং একাধিক রাজ্য সরকার (প্রতিটি রাজ্যের জন্য) রয়েছে। সংবিধান এই দুই ধরনের সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছে:

  • কেন্দ্র তালিকা: যে বিষয়গুলিতে শুধু কেন্দ্রীয় সরকার আইন তৈরি করতে পারে (যেমন – প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, রেল)।
  • রাজ্য তালিকা: যে বিষয়গুলিতে রাজ্য সরকার আইন তৈরি করতে পারে (যেমন – পুলিশ, কৃষি, স্বাস্থ্য)।
  • যুগ্ম তালিকা: যে বিষয়গুলিতে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ই আইন তৈরি করতে পারে (যেমন – শিক্ষা, অরণ্য)।

৮. ভারতীয় সংবিধানের প্রধান মৌলিক অধিকারগুলি কী কী? [৫ নম্বর]

উত্তর: ভারতের সংবিধান দেশের নাগরিকদের ৬টি প্রধান মৌলিক অধিকার দিয়েছে:

  1. সাম্যের অধিকার: জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান এবং সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ।
  2. স্বাধীনতার অধিকার: কথা বলার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভারতের যেকোনো স্থানে বসবাস ও যাতায়াতের স্বাধীনতা।
  3. শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার: জোর করে বা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো (বেগার খাটানো) এবং শিশুশ্রম নিষিদ্ধ।
  4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার: প্রত্যেকে নাগরিক স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম পালন ও প্রচার করতে পারে।
  5. সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার: প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিজের ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারে।
  6. সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার: উপরের কোনো অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে, নাগরিকরা সরাসরি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের কাছে বিচার চাইতে পারে।

৯. ‘সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার’-কে ডঃ আম্বেদকর ‘সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা’ বলেছেন কেন? [৩ নম্বর]

উত্তর: অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলি কেবল ঘোষণামাত্র। কিন্তু ‘সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার’ (Article 32) হলো সেই অধিকার, যা অন্য অধিকারগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে সাহায্য করে। যদি কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার সরকার বা অন্য কেউ কেড়ে নেয়, তবে এই অধিকারের বলেই নাগরিক সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে নালিশ জানাতে পারে এবং আদালত সেই অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই রক্ষাকবচটি আছে বলেই অন্যান্য অধিকারগুলি অর্থপূর্ণ। তাই ডঃ আম্বেদকর একে ‘সংবিধানের হৃদয় ও আত্মা’ (Heart and Soul) বলে অভিহিত করেছেন।

১০. ‘মৌলিক কর্তব্য’ ও ‘নির্দেশমূলক নীতি’-র মধ্যে পার্থক্য কী? [৩ নম্বর]

উত্তর:

  • মৌলিক কর্তব্য (Fundamental Duties): এগুলি হলো সংবিধানের প্রতি নাগরিকদের দায়িত্ব (যেমন – সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে সম্মান করা, জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা)। এগুলি পালন করা নাগরিক হিসাবে আমাদের কর্তব্য, কিন্তু এগুলি আইনত বাধ্যতামূলক নয় (আদালতে বিচার চাওয়া যায় না)।
  • নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles): এগুলি হলো রাষ্ট্রের প্রতি সংবিধানের নির্দেশ। রাষ্ট্র যখন আইন বা নীতি তৈরি করবে, তখন এই আদর্শগুলি (যেমন – সম্পদের সুষম বণ্টন, অবৈতনিক শিক্ষা, গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন) মাথায় রেখে চলবে। এগুলিও আইনত বাধ্যতামূলক নয়, তবে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে কাজ করে।

১১. ‘সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার’ কী? [২ নম্বর]

উত্তর: এর অর্থ হলো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সম্পত্তি বা শিক্ষার যোগ্যতা নির্বিশেষে, দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক (বর্তমানে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী) নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার পাবেন। ভারতীয় সংবিধান এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu