বিষয়: অতীত ও ঐতিহ্য
অধ্যায় ৮: সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশভাগ (প্রকল্প নোটস)
মূল ধারণা ও প্রশ্নাবলী
১. ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ (Divide and Rule) নীতি কী?
উত্তর: ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ ছিল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একটি প্রধান রাজনৈতিক কৌশল। ব্রিটিশ শাসকরা বুঝতে পেরেছিল যে, ভারতের হিন্দু ও মুসলিম এই দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়কে যদি ঐক্যবদ্ধ হতে দেওয়া হয়, তবে তা ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক হবে। তাই তারা সচেতনভাবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ, সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে উস্কে দেয়, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে নামতে না পারে। এই বিভেদ সৃষ্টির কৌশলই ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি নামে পরিচিত।
২. ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলতে কী বোঝো?
উত্তর: সাম্প্রদায়িকতা হলো একটি নেতিবাচক ধারণা। যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধান পরিচয় বলে মনে করে এবং সেই ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে শত্রু বা প্রতিপক্ষ বলে গণ্য করে, তখন তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে। এটি জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী একটি ধারণা, যা শেষ পর্যন্ত সমাজে বিভেদ ও হিংসার জন্ম দেয়।
৩. ‘পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা’ (১৯০৯) কীভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উস্কে দিয়েছিল?
উত্তর: ১৯০৯ সালের ‘মরলে-মিন্টো’ সংস্কার আইনে মুসলিমদের জন্য ‘পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা’ চালু করা হয়।
- এই ব্যবস্থার ফলে মুসলিম প্রার্থীদের জন্য আসন সংরক্ষিত করা হয় এবং সেই আসনে শুধুমাত্র মুসলিম ভোটাররাই ভোট দিতে পারতেন।
- এর ফলে হিন্দু ও মুসলিম—এই দুই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক স্বার্থ ও পরিচয় সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়।
- রাজনৈতিক নেতারা শুধুমাত্র নিজেদের সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক প্রচার শুরু করেন, যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে আইনি ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয় এবং দেশভাগের পথ প্রশস্ত করে।
৪. ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ কী? এর প্রধান প্রবক্তা কে ছিলেন?
উত্তর: ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ হলো একটি রাজনৈতিক মতবাদ যার মূল কথা হলো— ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রীতিনীতি সম্পূর্ণ আলাদা, তাই তারা কখনো এক হয়ে একটি অখণ্ড জাতি হিসেবে বাস করতে পারে না।
প্রবক্তা: এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ। তিনি দাবি করেন যে, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি হওয়ায় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র (পাকিস্তান) প্রয়োজন।
৫. ১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব’-এর গুরুত্ব কী?
উত্তর: ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে মহম্মদ আলি জিন্নাহ-র সভাপতিত্বে একটি প্রস্তাব পাস হয়, যা ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।
গুরুত্ব:
- এই প্রস্তাবেই প্রথমবার মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলা হয়।
- এতে বলা হয়, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” (Independent States) গঠন করতে হবে।
- এই প্রস্তাবটিই পরবর্তীকালে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিতি পায় এবং এটিই ছিল দেশভাগের পথে একটি আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ।
চিত্র: দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণা। এই তত্ত্ব অখণ্ড ভারতকে ভেঙে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানায়।
৬. ‘ক্রিপস মিশন’ (১৯৪২) কেন ভারতে এসেছিল? এটি কেন ব্যর্থ হয়?
উত্তর:
আসার কারণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪২) জাপান ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধের জন্য ভারতীয়দের পূর্ণ সমর্থন আদায় করার উদ্দেশ্যে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ‘ক্রিপস মিশন’ ভারতে পাঠানো হয়।
ব্যর্থতার কারণ:
- ক্রিপস মিশন ভারতকে অবিলম্বে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার বদলে যুদ্ধের পর ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ (ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন) দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
- কংগ্রেস ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’-র দাবিতে অটল থাকে। গান্ধীজি এই প্রস্তাবকে ‘ফেল পড়া ব্যাঙ্কের ওপর আগামী তারিখের চেক’ (a post-dated cheque on a failing bank) বলে উপহাস করেন।
- মুসলিম লিগও পৃথক পাকিস্তানের দাবিชัดভাবে মেনে না নেওয়ায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
৭. ‘মন্ত্রী মিশন’ বা ‘ক্যাবিনেট মিশন’ (১৯৪৬) কী ছিল? এর প্রধান প্রস্তাবগুলি কী ছিল?
উত্তর:
মন্ত্রী মিশন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়গুলি আলোচনা করতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় খুঁজতে তিনজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে (পেথিক লরেন্স, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এ. ভি. আলেকজান্ডার) ভারতে পাঠায়। এটিই ‘মন্ত্রী মিশন’ বা ‘ক্যাবিনেট মিশন’ নামে পরিচিত।
প্রধান প্রস্তাব:
- যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো: মিশন অখণ্ড ভারতের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়, যেখানে কেন্দ্র সরকারের হাতে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের দায়িত্ব থাকবে।
- প্রদেশগুলির ক্ষমতা: বাকি সমস্ত ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতে থাকবে। প্রদেশগুলিকে ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’—এই তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়।
- পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান: এই মিশন মুসলিম লিগের পৃথক পাকিস্তানের দাবিকে সরাসরি নাকচ করে দেয়।
- অন্তর্বর্তী সরকার: অবিলম্বে সমস্ত প্রধান দলগুলিকে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
৮. ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (Direct Action Day) (১৯৪৬) কী? এর ফলাফল কী হয়েছিল?
উত্তর:
প্রেক্ষাপট: মন্ত্রী মিশন (ক্যাবিনেট মিশন) পৃথক পাকিস্তানের দাবি নাকচ করে দিলে মহম্মদ আলি জিন্নাহ ক্ষুব্ধ হন। তিনি ঘোষণা করেন যে, মুসলিম লিগ এবার “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম”-এর মাধ্যমে পাকিস্তান আদায় করবে।
ঘটনা: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালনের ডাক দেয়। ওই দিন কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, যা ‘কলকাতার ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড’ (The Great Calcutta Killings) নামে পরিচিত। এই দাঙ্গায় হাজার হাজার নিরীহ হিন্দু ও মুসলমান প্রাণ হারান এবং বহু মানুষ গৃহহীন হন।
ফলাফল: এই দাঙ্গা দ্রুত বাংলা ছাড়িয়ে নোয়াখালি, বিহার এবং পাঞ্জাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভয়াবহ রক্তপাত প্রমাণ করে দেয় যে, হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে আর এক ছাদের তলায় থাকা সম্ভব নয়। এই ঘটনাই দেশভাগকে অনিবার্য করে তোলে।
৯. ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ (১৯৪৭) কী?
উত্তর: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল হয়ে আসেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, অখণ্ড ভারত রক্ষা করা আর সম্ভব নয়।
তাই তিনি ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ভারত ভাগের একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় বলা হয়:
- ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র তৈরি করা হবে।
- বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ দুটিকেও ধর্মীয় ভিত্তিতে ভাগ করা হবে।
- সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে গণভোটের মাধ্যমে স্থির করা হবে তারা কোন রাষ্ট্রে যোগ দেবে।
এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’ (১৯৪৭) পাস হয়।
১০. দেশভাগের দুটি প্রধান ফলাফল লেখো।
উত্তর: ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দুটি প্রধান ফলাফল হলো:
- উদ্বাস্তু সমস্যা: দেশভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু, মুসলিম ও শিখ মানুষ তাঁদের ভিটেমাটি ছেড়ে সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে (ভারত থেকে পাকিস্তান বা পাকিস্তান থেকে ভারত) চলে আসতে বাধ্য হন। এই বিপুল সংখ্যক ছিন্নমূল মানুষ ‘উদ্বাস্তু’ সমস্যা নামে পরিচিত এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের জন্ম দেন।
- সাম্প্রদায়িক হিংসা: দেশভাগকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাব ও বাংলায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হন এবং অগণিত নারী নির্যাতিত ও অপহৃত হন।