বিষয়: অতীত ও ঐতিহ্য
অধ্যায় ৪: ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র (প্রকল্প নোটস)
মূল ধারণা ও প্রশ্নাবলী
১. ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ কে, কবে এবং কেন চালু করেন?
উত্তর:
- কে: লর্ড কর্নওয়ালিস।
- কবে: ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে।
- কারণ:
- কোম্পানির রাজস্ব আদায়কে সুনিশ্চিত করা, যাতে প্রতি বছর রাজস্বের পরিমাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা না থাকে।
- জমিদারদের জমির ওপর স্থায়ী অধিকার দিলে তারা কৃষির উন্নতির জন্য অর্থ বিনিয়োগ করবে বলে আশা করা হয়েছিল।
- অসংখ্য কৃষকের বদলে কম সংখ্যক জমিদারের থেকে রাজস্ব আদায় করা প্রশাসনিকভাবে সহজ ছিল।
- জমিতে অধিকার স্থায়ী করে জমিদারদের কোম্পানির অনুগত গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলা।
২. ‘সূর্যাস্ত আইন’ কী ছিল?
উত্তর: ‘সূর্যাস্ত আইন’ ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি শর্ত। এই আইন অনুযায়ী, জমিদারকে একটি নির্দিষ্ট তারিখের সূর্যাস্তের আগে কোম্পানির প্রাপ্য রাজস্ব জমা দিতে হতো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব জমা দিতে না পারলে জমিদারের সম্পত্তি (জমিদারি) কোম্পানি নিলামে বিক্রি করে দিতে পারত।
৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক সমাজের ওপর কী প্রভাব পড়েছিল?
উত্তর:
- অধিকার লোপ: এই ব্যবস্থায় কৃষকের জমির ওপর চিরাচরিত দখলি স্বত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং তারা জমিদারের অনুগ্রহ-নির্ভর ‘প্রজা’-তে পরিণত হয়।
- অতিরিক্ত করের বোঝা: জমিদাররা উঁচু হারে রাজস্ব আদায়ের জন্য কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিত।
- বেআইনি কর: জমিদাররা নির্দিষ্ট খাজনা ছাড়াও ‘আবওয়াব’ বা বিভিন্ন বেআইনি কর কৃষকদের থেকে আদায় করত।
- জমি থেকে উচ্ছেদ: নির্দিষ্ট খাজনা দিতে না পারলে কৃষকের জমি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার জমিদারের ছিল, ফলে কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে।
৪. ‘রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত’ ও ‘মহলওয়ারি বন্দোবস্ত’ বলতে কী বোঝো?
উত্তর:
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত:
- এই ব্যবস্থা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে (প্রধানত মাদ্রাজ ও বোম্বাই) চালু করা হয়।
- এই ব্যবস্থায় কোম্পানি কোনো জমিদারের মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি ‘রায়ত’ বা কৃষকের সঙ্গে ভূমি-রাজস্বের বন্দোবস্ত করে।
- এর ফলে কৃষক বা রায়ত জমির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি পায় (যদিও বাস্তবে তারা ছিল ভাড়াটে চাষি)।
- এই বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী ছিল না; নির্দিষ্ট সময় অন্তর (সাধারণত ২০-৩০ বছর) রাজস্বের পরিমাণ সংশোধন করা হতো, এবং তা প্রায়শই বাড়ানো হতো।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত:
- এই ব্যবস্থা উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে (যেমন – গাঙ্গেয় উপত্যকা, মধ্য ভারত) চালু করা হয়।
- ‘মহল’ কথাটির অর্থ হলো কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি।
- এই ব্যবস্থায় সরকার কোনো একজন কৃষকের সঙ্গে নয়, বরং গোটা ‘মহল’ বা গ্রাম সম্প্রদায়ের প্রধান বা জমিদারের সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করত।
- এখানেও নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজস্বের হার সংশোধন করা হতো, যা কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করত।
চিত্র: তিনটি প্রধান ভূমি-রাজস্ব বন্দোবস্ত।
৫. ‘কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ’ বলতে কী বোঝো? এর একটি উদাহরণ দাও।
উত্তর: ঔপনিবেশিক আমলে কৃষকদের খাদ্যশস্যের (যেমন – ধান, গম) বদলে বাণিজ্যের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কিছু ফসল (যাকে ‘Cash Crop’ বলে) চাষ করতে বাধ্য করা হতো। এই প্রক্রিয়াকে ‘কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ’ বলে।
উদাহরণ: ইংল্যান্ডের কাপড় কলের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করা হতো। একইভাবে, চা, পাট, তুলো, কফি ইত্যাদি বাণিজ্যিক ফসলের চাষ বাড়ানো হয়েছিল।
৬. ‘দাদন’ কী? নীল চাষের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ছিল?
উত্তর: ‘দাদন’ কথার অর্থ হলো ‘অগ্রিম অর্থ’।
নীলকর সাহেবরা কৃষকদের নীল চাষ করার জন্য বিঘা প্রতি কিছু টাকা অগ্রিম বা ‘দাদন’ নিতে বাধ্য করত। কৃষক একবার এই দাদন নিলে সেই টাকায় কার্যত ‘বাঁধা’ পড়ে যেত। পরবর্তীকালে অত্যন্ত কম দামে নীলকরদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য থাকত এবং সেই ঋণ কখনও শোধ হতো না। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের ওপর শোষণ চালানো হতো।
৭. ‘বাগিচা শিল্প’ কী? আসামের চা-বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর: ‘বাগিচা শিল্প’ হলো এক ধরনের কৃষি-শিল্প যেখানে বিশাল জমি নিয়ে চা, কফি, রবার ইত্যাদির বড় বাগান তৈরি করা হয়। ঊনবিংশ শতকে আসাম, বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে ইউরোপীয় মালিকানায় চা ও কফি বাগিচা শিল্পের বিকাশ ঘটে।
শ্রমিকদের অবস্থা:
- আসামের চা-বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
- তাদের সামান্য মজুরি দেওয়া হতো এবং চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে কাজ করতে হতো।
- ইউরোপীয় মালিকরা (প্ল্যান্টার) শ্রমিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করত।
- ব্রাহ্মনেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় চা-বাগানের শ্রমিকদের এই অত্যাচারের খবর প্রকাশ করে জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
৮. ‘দাক্ষিণাত্য হাঙ্গামা’ (১৮৭৫) কেন হয়েছিল?
উত্তর: ‘দাক্ষিণাত্য হাঙ্গামা’ ছিল মহারাষ্ট্রের পুনা ও আহমদনগর জেলার তুলো চাষিদের একটি বিদ্রোহ।
কারণ:
- আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬০-এর দশক) সময় দাক্ষিণাত্যে তুলোর চাহিদা ও দাম খুব বেড়ে যায়।
- কিন্তু গৃহযুদ্ধ থেমে গেলে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তুলোর দাম হঠাৎ করে একদম কমে যায়।
- এই অবস্থায় কৃষকদের ওপর ঔপনিবেশিক সরকারের চড়া রাজস্বের চাপ ছিল।
- এই সুযোগে স্থানীয় ‘সাহুকার’ (মহাজন) শ্রেণী চড়া সুদে ঋণ দিয়ে কৃষকদের জমি ও ফসল দখল করে নিত।
এই শোষণ ও ঋণের বোঝার বিরুদ্ধেই কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে সাহুকারদের বাড়ি ও তাদের ঋণের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়।
৯. ‘অবশিল্পায়ন’ (De-industrialization) বলতে কী বোঝো?
উত্তর: ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে ব্রিটিশ পণ্য (বিশেষত ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড়) অবাধে আমদানি হতে থাকে। অন্যদিকে, ব্রিটেনে ভারতীয় বস্ত্রের ওপর চড়া শুল্ক বসানো হয়।
এই অসম প্রতিযোগিতার ফলে ভারতের ঐতিহ্যবাহী দেশীয় শিল্পগুলি, বিশেষত সুতিবস্ত্র ও হস্তশিল্প, ধ্বংস হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ কারিগর ও শিল্পী কর্মচ্যুত হয়ে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভারতীয় শিল্পের এই অবলুপ্তির প্রক্রিয়াকে ‘অবশিল্পায়ন’ বলা হয়।
১০. ‘সম্পদের বহির্গমন’ (Drain of Wealth) কাকে বলে?
উত্তর: ঔপনিবেশিক আমলে ভারত থেকে প্রভূত সম্পদ (টাকা, কাঁচামাল, মুনাফা) নানা উপায়ে ব্রিটেনে চলে যেত, কিন্তু তার বিনিময়ে ভারত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো না।
কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, যুদ্ধের খরচ, কাঁচামাল কেনা—এই সমস্ত কিছুই ভারতের রাজস্ব থেকে মেটানো হতো এবং সেই সম্পদ ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত হতো। দেশের সম্পদ এইভাবে বিদেশে চলে যাওয়াকেই দাদাভাই নৌরজি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখরা ‘সম্পদের বহির্গমন’ বলে অভিহিত করেছেন।
বলা হতো, ব্রিটিশ শাসন ‘স্পঞ্জের মতো’ কাজ করত—ভারতের সম্পদ শুষে নিয়ে তা ব্রিটেনে পাঠিয়ে দিত।
চিত্র: সম্পদের বহির্গমন। ব্রিটিশ শাসন স্পঞ্জের মতো ভারতের সম্পদ শুষে ব্রিটেনে পাঠাতো।
১১. ভারতে রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?
উত্তর: লর্ড ডালহৌসির আমলে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ভারতের উন্নয়ন ছিল না, বরং তা ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করা:
- সামরিক উদ্দেশ্য: বিদ্রোহ বা গোলযোগ দেখা দিলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানো।
- বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য: ব্রিটিশ কারখানায় তৈরি পণ্য (যেমন – ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড়) বন্দর থেকে দেশের ভিতরের বাজারগুলিতে পৌঁছে দেওয়া।
- কাঁচামাল সংগ্রহ: দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাঁচামাল (যেমন – তুলো, পাট) সংগ্রহ করে তা রপ্তানির জন্য বন্দরে নিয়ে আসা।
- ব্রিটিশ মূলধন বিনিয়োগ: ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা যাতে নিরাপদে উচ্চ হারে সুদ পেতে পারে, তার জন্য রেলপথ নির্মাণে মূলধন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়।
১২. ভারতে রেলপথ নির্মাণের দুটি নেতিবাচক প্রভাব উল্লেখ করো।
উত্তর:
- পরিবেশগত ক্ষতি: রেলপথ বসানোর জন্য প্রচুর জঙ্গল ও গাছ কাটা হয়, যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং অরণ্যবাসী জনগোষ্ঠীগুলি বাস্তুচ্যুত হয়।
- দেশীয় শিল্পের ক্ষতি: রেলপথের মাধ্যমে ব্রিটিশ পণ্য সহজেই গ্রামের বাজারগুলিতে পৌঁছে যায়, ফলে স্থানীয় হস্তশিল্পীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যায় (অবশিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয়)।
১৩. টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা কেন এবং কীভাবে ভারতে গড়ে তোলা হয়েছিল?
উত্তর: ঔপনিবেশিক শাসনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনে লর্ড ডালহৌসির আমলে ভারতে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
উদ্দেশ্য: এর মূল উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমস্ত জরুরি সংবাদ ও তথ্য (বিশেষত বিদ্রোহ বা গোলযোগের খবর) খুব দ্রুত শাসনকেন্দ্রগুলিতে (যেমন কলকাতা) পৌঁছানো। ১৮৫৭-র বিদ্রোহ দমনে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ব্রিটিশদের খুব সাহায্য করেছিল।
কীভাবে: সাধারণত রেলপথ বরাবরই টেলিগ্রাফ লাইন তৈরি করা হতো, যা রেল চলাচলের সিগন্যাল ব্যবস্থার কাজেও লাগত।