বিষয়: অতীত ও ঐতিহ্য
অধ্যায় ৩: ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা (প্রকল্প নোটস)
মূল ধারণা ও প্রশ্নাবলী
১. ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থা বলতে কী বোঝো? প্রধান তিনটি প্রেসিডেন্সির নাম লেখো।
উত্তর: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্যের স্বার্থে মাদ্রাজ, বোম্বাই ও কলকাতা – এই তিনটি প্রধান ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে তাদের বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কার্যকলাপ চালাত। এই তিনটি কেন্দ্রিক অঞ্চল ‘প্রেসিডেন্সি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ব্যবস্থাকেই ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থা বলা হয়।
প্রধান তিনটি প্রেসিডেন্সি হলো:
- মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (সেন্ট জর্জ দুর্গ প্রেসিডেন্সি)
- বোম্বাই প্রেসিডেন্সি
- বাংলা প্রেসিডেন্সি (ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ প্রেসিডেন্সি)
২. ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট’ (১৭৭৩) কেন পাস করা হয়? এর প্রধান ফল কী হয়েছিল?
উত্তর: ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যকলাপের উপর ব্রিটেনের পার্লামেন্টের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস করা হয়।
প্রধান ফল: এই আইনের ফলে ‘গভর্নর জেনারেল’ নামে একটি নতুন পদ তৈরি করা হয়। বাংলার গভর্নরকেই গভর্নর জেনারেলের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সি তাঁর অধীনে চলে আসে। এর ফলে কলকাতা কার্যত ভারতে ব্রিটিশ শাসনের রাজধানীতে পরিণত হয়।
৩. ‘পিট-এর ভারত শাসন আইন’ (১৭৮৪) কী ছিল?
উত্তর: ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়ম পিট এই আইনটি পাস করেন। এই আইনের ফলে ভারতে কোম্পানির কার্যকলাপের উপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নজরদারি আরও সুনিশ্চিত হয়। এই আইন দ্বারা একটি ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল’ তৈরি করা হয়, যা কোম্পানির সামরিক, অসামরিক ও রাজস্ব ব্যবস্থার পরিচালনা করত।
৪. ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার ব্যবস্থার সংস্কারগুলি লেখো।
উত্তর: ওয়ারেন হেস্টিংসের বিচার ব্যবস্থার সংস্কারগুলি হলো:
- ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতি জেলায় একটি করে ‘দেওয়ানি’ (রাজস্ব) এবং একটি ‘ফৌজদারি’ (ফৌজদারি) আদালত তৈরি করেন।
- দেওয়ানি আদালতের প্রধান হতেন ইউরোপীয় কালেক্টর, তবে হিন্দু আইন ব্যাখ্যার জন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও মুসলিম আইন ব্যাখ্যার জন্য মৌলবীরা থাকতেন।
- ফৌজদারি আদালত চলত কাজি ও মুফতির অধীনে, যদিও তার তত্ত্বাবধানেও ইউরোপীয়রাই ছিলেন।
- তিনি হিন্দু ও মুসলিম আইনগুলির একটি সারসংকলন তৈরি করান, যাতে ইউরোপীয় বিচারকদের দেশীয় সহকারীদের উপর নির্ভর করতে না হয়।
৫. ‘কর্নওয়ালিস কোড’ (১৭৯৩) কী?
উত্তর: গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে আইনগুলিকে সংহত করে যে ‘কোড’ বা ‘বিধিবদ্ধ আইন’ চালু করেন, তাকে ‘কর্নওয়ালিস কোড’ বলে। এর ফলে দেওয়ানি বিচার এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব আলাদা করা হয় এবং আদালত ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়।
৬. ঔপনিবেশিক পুলিশ ব্যবস্থার ‘দারোগা ব্যবস্থা’ সম্পর্কে লেখো।
উত্তর: ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস জেলাগুলিতে আইনশৃঙ্খলার দেখভাল করার জন্য পুলিশ থানা ব্যবস্থা চালু করেন।
- প্রতিটি থানার দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘দারোগা’ নামক একজন কর্মচারীর হাতে।
- এই দারোগাদের নিয়ন্ত্রণ করত জেলার ম্যাজিস্ট্রেট।
- স্থানীয় অঞ্চলে সাধারণ মানুষের কাছে এই দারোগারাই ছিল কোম্পানি-শাসনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক।
- তবে দারোগারা স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলত, ফলে সাধারণ মানুষের উপর যৌথ পীড়ন চলত।
৭. ‘সিভিল সার্ভিস’ বা আমলাতন্ত্র কে, কেন চালু করেন?
উত্তর: লর্ড কর্নওয়ালিস ‘সিভিল সার্ভিস’ বা অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা (আমলাতন্ত্র) চালু করেন।
কারণ: এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করা। কর্নওয়ালিসের ধারণা ছিল, উপযুক্ত বেতন না পাওয়ার ফলেই কর্মচারীরা সততার সঙ্গে কাজ করে না। তাই তিনি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দেন এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও উপহার নেওয়া নিষিদ্ধ করেন। এই আমলারাই ছিল ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান হাতিয়ার।
চিত্র: ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান স্তম্ভসমূহ।
৮. ‘আইনের শাসন’ এবং ‘আইনের চোখে সমতা’ ধারণা দুটি কী ছিল?
উত্তর:
- আইনের শাসন: এই ধারণা অনুযায়ী, ঔপনিবেশিক প্রশাসন শাসকের খামখেয়ালি ইচ্ছায় চলবে না, বরং আইন মেনে কাজ করবে।
- আইনের চোখে সমতা: এই ধারণা অনুযায়ী, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রে একই আইন চালু হবে।
বাস্তবে এই দুটি ধারণাই পুরোপুরি মানা হতো না। ইউরোপীয়দের বিচারের জন্য আলাদা আদালত ছিল এবং আইনি ব্যবস্থা খুব ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ মানুষ তার সুবিধা পেত না।
৯. ‘প্রাচ্যবাদী’ ও ‘পাশ্চাত্যবাদী’ শিক্ষা বিতর্ক কী ছিল?
উত্তর: উনিশ শতকের গোড়ায় ভারতে শিক্ষা প্রসারের বিষয়ে কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে দুটি প্রধান দল তৈরি হয়:
১. প্রাচ্যবাদী (Orientalists): ওয়ারেন হেস্টিংস, উইলিয়াম জোনস, জোনাথন ডানকানের মতো প্রশাসকরা মনে করতেন, ভারতীয়দের শিক্ষা দেওয়া উচিত তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, ভাষা (সংস্কৃত, আরবি, ফারসি) ও শাস্ত্রের মাধ্যমে। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১), এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪) এবং বেনারস হিন্দু কলেজ (১৭৯১) প্রতিষ্ঠা করেন।
২. পাশ্চাত্যবাদী (Anglicists): টমাস ব্যাবিংটন মেকলে বা আলেকজান্ডার ডাফের মতো ব্যক্তিরা মনে করতেন, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা অর্থহীন ও কুসংস্কারে পূর্ণ। তাঁরা ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান (গণিত, দর্শন, বিজ্ঞান) শেখানোর পক্ষে সওয়াল করেন।
এই বিতর্ক ‘প্রাচ্যবাদী-পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক’ নামে পরিচিত।
১০. ‘মেকলের প্রতিবেদন’ (Macaulay’s Minute) কী ছিল?
উত্তর: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে শিক্ষা প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন বা ‘মিনিটস’ পেশ করেন। একেই ‘মেকলের প্রতিবেদন’ বলে।
এর মূল কথা ছিল:
- ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার করতে হবে।
- সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শিক্ষার জন্য কোনো সরকারি অনুদান দেওয়া হবে না।
- মেকলে আশা করেছিলেন, এর ফলে এমন একটি “ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি” তৈরি হবে, যারা “জন্মগতভাবে ভারতীয় হলেও রুচি, আদর্শ ও নৈতিক আচরণের দিক থেকে হবে ব্রিটিশ”।
১১. ‘উডের প্রতিবেদন’ (Wood’s Despatch) কী? এর প্রধান সুপারিশ কী ছিল?
উত্তর: ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড শিক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশ করেন, যা ‘উডের প্রতিবেদন’ নামে পরিচিত। একে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার ‘মহাসনদ’ বা ম্যাগনাকার্টা বলা হয়।
প্রধান সুপারিশ: এই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত একটি সুগঠিত শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও ভারতীয়—দু-ধরনের ভাষার চর্চার কথাই এতে বলা হয়েছিল। এই প্রতিবেদন অনুসারেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়।
১২. জেমস রেনেল কে ছিলেন?
উত্তর: জেমস রেনেল ছিলেন একজন ব্রিটিশ জরিপবিদ। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলার নদীপথগুলি জরিপ করেন। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি তাকে ভারতের ‘সার্ভেয়ার জেনারেল’ বা জরিপ বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে। বাংলার নদীপথের উপর ভিত্তি করে তিনি মোট ১৬টি মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, যা বাংলার প্রথম আধুনিক মানচিত্র হিসেবে গণ্য হয়।
১৩. ‘ইজারাদারি ব্যবস্থা’ (পাঁচসালা বন্দোবস্ত) কে, কেন চালু করেন?
উত্তর: ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস ‘ইজারাদারি ব্যবস্থা’ চালু করেন।
কারণ: রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সুনিশ্চিত করা ও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়।
ব্যবস্থা: এই ব্যবস্থা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি জমির নিলামে সবথেকে বেশি খাজনা দেওয়ার ডাক দিত, তার সঙ্গে কোম্পানি ৫ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত করত। ৫ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হতো বলে একে ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত’-ও বলা হয়।
অতিরিক্ত প্রশ্নাবলী
১৪. ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় উইলিয়াম কেরির অবদান কী ছিল?
উত্তর: উইলিয়াম কেরি ছিলেন শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের একজন প্রধান মিশনারি। তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন ও মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। তিনি ভারতীয় মহাকাব্যগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং বাইবেলের বিভিন্ন অংশ ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি হালেদের লেখা বাংলা ব্যাকরণ বইটি সম্পাদনা করে পুনরায় প্রকাশ করেন।
১৫. ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ (১৮০০) কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল?
উত্তর: গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, ভারতে আসা ইউরোপীয় সিভিল সার্ভেন্ট (আমলা) ও প্রশাসকদের ভারতের প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া। এখানে তাদের ভারতের ভাষা, আইন ও রীতিনীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হতো।
১৬. ‘সামরিক জাতি’ (Martial Race) তত্ত্বটি কী?
উত্তর: এটি ছিল ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি একটি ধারণা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা সিপাহিবাহিনীকে ঢেলে সাজায়।
- তাদের ধারণা জন্মায় যে, কিছু নির্দিষ্ট জাতির মানুষেরা (যেমন – পঞ্জাবের জাঠ, পাঠান, নেপালি গুর্খা) স্বভাবগতভাবেই বেশি যুদ্ধবাজ, দক্ষ ও অনুগত হয়। এদেরকেই ‘সামরিক জাতি’ বলা হতো।
- অন্যদিকে, যারা ভাত খায় (যেমন বাঙালি) বা যারা বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল (যেমন অযোধ্যার উচ্চবর্ণের সেনারা), তাদের ‘অ-সামরিক’ ও দুর্বল বলে চিহ্নিত করা হয়।
- এই তত্ত্বের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে গুর্খা ও পঞ্জাবিদের সংখ্যা বাড়ানো হয়।
১৭. ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিস্তারের মূল উদ্দেশ্য ও সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
উত্তর:
মূল উদ্দেশ্য:
- প্রশাসনের কাজের জন্য কম বেতনের কেরানি বা কর্মচারী তৈরি করা।
- এমন একটি অনুগত শ্রেণি তৈরি করা, যারা ব্রিটিশ শাসনকে নৈতিকভাবে সমর্থন জানাবে (মেকলের প্রতিবেদন অনুযায়ী)।
- পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়দের ‘সভ্য’ করে তোলা এবং ব্রিটিশ পণ্যের প্রতি তাদের আগ্রহী করে তোলা।
সীমাবদ্ধতা:
- এই শিক্ষা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক এবং সমাজের উচ্চবর্গের (‘ভদ্রলোক’) মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
- সার্বিক গণশিক্ষার (সকলের জন্য শিক্ষা) কোনো পরিকল্পনা এতে ছিল না।
- নারীশিক্ষার বিষয়টিকে প্রথমদিকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয়েছিল।
- হাতেকলমে বা কারিগরি শিক্ষার বদলে পুঁথিগত বিদ্যার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ে।