প্রথম পাঠ: বোঝাপড়া (নোট)
প্রসেসিং হচ্ছে…

বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)

প্রথম পাঠ: বোঝাপড়া (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) – নোটস ও উত্তর

**উৎস:** ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থ | **বিষয়বস্তু:** জীবনদর্শন, আত্ম-মীমাংসা ও বাস্তবতার স্বীকারোক্তি।

— ### ১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Philosophy)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটি জীবনের এক গভীর ও চিরন্তন সত্যকে সহজ ভাষায় তুলে ধরেছে। এই কবিতার মূল সুর হলো—পৃথিবী এবং মানুষ কেউই নিখুঁত নয়, তাই জীবনের সব ভালো-মন্দ, আঘাত-প্রতিঘাতকে সহজভাবে মেনে নিতে হবে।

মূল বক্তব্য:

  • জীবন চলার পথে কেউ ভালোবাসবে, কেউ বা বাসবে না—এটাই জগতের নিয়ম। এটি কারো স্বভাবের দোষ, আবার কারো নিয়তি।
  • তুমিও সবার মাপে তৈরি নও, আবার অন্য কেউও তোমার মাপে তৈরি নয়। এই ভিন্নতা স্বাভাবিক।
  • কোনো দুঃখ বা ব্যর্থতা যদি আসে, তবে তা নিয়ে সবার সঙ্গে ঝগড়া না করে শান্তভাবে মেনে নিতে হবে (‘টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো’) অথবা ভেসে থাকতে পারলে সেটাই শ্রেষ্ঠ।
  • নিজের ব্যর্থতাকে বড়ো করে দেখে (‘নিজের ছায়া মস্ত করে’) জীবনকে অন্ধকার করে তোলা বোকামি।
  • যখনই ভুল বুঝতে পারবে, তখনই মনের সঙ্গে আপোস (বোঝাপড়া) করে নতুন করে পথ চলতে হবে এবং অতীতের সব তফাৎ ভুলে জীবনের আলো জ্বালতে হবে।
— ### ২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দার্থ
  • **মান্ধাতার আমল:** রাবণরাজার সমসাময়িক মান্ধাতার যুগ বা অতি প্রাচীনকাল।
  • **আর্তরবে:** কাতর ধ্বনিতে।
  • **শ্রেয়:** সংগত, উপযুক্ত, কল্যাণকর।
  • **ডাগর:** দীর্ঘ, বড়ো।
  • **বোঝাপড়া:** আপোস, মীমাংসা।
  • **জখম:** আঘাত, ক্ষত।
— ### ৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)

(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):

১. জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত কোন্ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত লিখতেন? [১ নম্বর]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত **ভারতী** ও **বালক** পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

২. ভারতের কোন্ প্রতিবেশী দেশে তাঁর লেখা গান জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয়? [১ নম্বর]

ভারতের প্রতিবেশী দেশ **বাংলাদেশের** জাতীয় সংগীত (‘আমার সোনার বাংলা’) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা।

৩. ‘সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়।’ কোন্টি সবার চেয়ে শ্রেয়? [২ নম্বর]

জীবনের সমস্ত আঘাত বা বিপর্যয়কে মেনে নিয়ে যদি ভেসে থাকা সম্ভব হয়, তবে **ভেসে থাকা** বা **বিপদের মোকাবিলা করে টিকে থাকা**ই সবার চেয়ে শ্রেয় বলে কবি মনে করেছেন।

৪. ‘ঘটনা সামান্য খুবই।’ কোন্ ঘটনার কথা বলা হয়েছে? [২ নম্বর]

কবিতায়, জীবনের সুখের বন্দরে এসেও অপ্রত্যাশিতভাবে **জলের তলে থাকা অদৃশ্য পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগা**র (অর্থাৎ জীবনে হঠাৎ আঘাত আসার) ঘটনাটিকে কবি ‘সামান্য খুবই’ বলেছেন।

৫. ‘মরণ এলে হঠাৎ দেখি / মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।’ ব্যাখ্যা করো। [২ নম্বর]

যখন জীবনের নানা দুঃখ-কষ্টে মানুষ বেঁচে থাকাকে অর্থহীন মনে করে, তখন মৃত্যু উপস্থিত হলে হঠাৎই সে উপলব্ধি করে যে, **মৃত্যুর চেয়ে জীবনই অনেক মধুর ও কাম্য**। এটি জীবনের প্রতি মানুষের সহজাত আসক্তিকে বোঝায়।

৬. ‘তাহারে বাদ দিয়েও দেখি / বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।’ উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে জীবনের কোন্ সত্য প্রকাশ পেয়েছে? [২ নম্বর]

উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে এই সত্যটি প্রকাশ পেয়েছে যে, আমরা যার জন্য গভীর দুঃখ ও অশ্রুপাত করি, সেই **ব্যক্তি বা বস্তুটি জীবনের সব কিছু নয়**। তাকে বাদ দিয়েও এই বিশ্বসংসার অনেক বড়ো এবং জীবনে বেঁচে থাকার আরও অনেক কারণ রয়েছে।

৭. কখন আঁধার ঘরে প্রদীপ জ্বালানো সম্ভব? [২ নম্বর]

যখন মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পেরে, **মনের সঙ্গে আপোস বা ‘বোঝাপড়া’ করে** এবং অন্য কারোর সঙ্গে তার তফাৎ কতটুকুন হলো, সেই হিসেব ভুলে যায়, তখনই মনের আঁধার ঘরে প্রদীপ জ্বালানো সম্ভব।

৮. ‘অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি / এলে সুখের বন্দরেতে,’ ‘ঝঞ্ঝা কাটিয়ে আসা’ বলতে কী বোঝো? [২ নম্বর]

‘ঝঞ্ঝা কাটিয়ে আসা’ বলতে কবি জীবনের **নানা সমস্যা, দুঃখ, দুর্গতি এবং কঠিন পরিস্থিতি** পার করে শান্ত ও সুখী জীবনে প্রবেশ করাকে বুঝিয়েছেন।

রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৩-৫ নম্বর):

৯. ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক / সত্যেরে লও সহজে।’ তুমি কি কবির সঙ্গে একমত? জীবনে চলার পথে নানা বাধাকে তুমি কীভাবে অতিক্রম করতে চাও? [৩ নম্বর]

কবিতাটির মূল ভাবনার সঙ্গে আমি **সম্পূর্ণ একমত**। জীবন একটি জটিল নদীর মতো, যেখানে সুখ (ভালো) যেমন থাকে, তেমনি দুঃখ ও ব্যর্থতা (মন্দ)ও আসে। কবি এখানে আঘাতকে সহজভাবে স্বীকার করে নেওয়ার কথা বলেছেন, যা একপ্রকার মানসিক সহনশীলতা।

জীবনে চলার পথে বাধা অতিক্রমের উপায়:

  • **বাস্তবতা মেনে নেওয়া:** আঘাত এলে অভিযোগ না করে, সেটিকে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা।
  • **ইতিবাচক মনোভাব:** অতীতের ব্যর্থতা বা আঘাতকে মনের মধ্যে পুষে না রেখে, ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
  • **আত্ম-নির্ভরশীলতা:** নিজের দোষে জীবন অন্ধকার করে না তুলে, নিজের ভেতরের আলো দিয়ে নতুন করে পথ তৈরি করা।

১০. ‘তেমন করে হাত বাড়ালে / সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।’ ‘তেমন করে’ কথাটির অর্থ বুঝিয়ে দাও। এখানে কবি কী ধরনের সুখের ইঙ্গিত করেছেন লেখো। [৩ নম্বর]

‘তেমন করে’ কথাটির অর্থ হলো **স্বার্থহীনভাবে, উদার ও বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে অপরের দিকে হাত বাড়ানো**।

কবিতায় কবি এই সুখের ইঙ্গিত করেছেন যে, জীবনে যদি কারও সঙ্গে মতের বা আচরণের পার্থক্য থাকে, তবে সেই ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া বা টানাটানি না করে, যদি আমরা একটুখানি উদার হই এবং অপরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়াই, তবে সেই **সহানুভূতি ও ভালোবাসার** মাধ্যমে যে মানসিক তৃপ্তি ও শান্তি পাওয়া যায়, তা-ই হলো সবচেয়ে বড়ো সুখ। এই সুখ ব্যক্তি-স্বার্থের ঊর্ধ্বে এক বৃহত্তর মানবীয় সম্পর্ক থেকে আসে।

১১. ‘নিজের ছায়া মস্ত করে…দোহাই তবে এ কার্যটা / যত শীঘ্র পারো সারো।’ কবি কোন্ কার্যের কথা বলেছেন? সেই কার্যটি শীঘ্র সারতে হবে কেন? [৩ নম্বর]

কার্যের পরিচয়: কবি এখানে সেই কার্যের কথা বলেছেন, যেখানে মানুষ **নিজের ক্ষুদ্র দুঃখ, ব্যর্থতা বা অভিমানকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে** নিজের জীবনকে অন্ধকার করে তোলে (‘নিজের ছায়া মস্ত করে / আঁধার করে তোলো যদি’) এবং বিধাতার (বা ভাগ্যের) ওপর দোষারোপ করে (‘বিধির সঙ্গে বিবাদ করে’) নিজের ক্ষতি করে। এই ‘কার্য’ হলো নিজের সঙ্গে ঝগড়া করা বা নিজেকে আঘাত দেওয়া।

শীঘ্র সারার কারণ: এই কাজটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলতে বলা হয়েছে, কারণ এই নেতিবাচক মানসিকতা জীবনকে শুধু নষ্টই করে না, বরং **বাস্তব জীবন থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন** করে দেয়। নিজের পায়ে কুড়ুল মারার মতো ক্ষতিকারক এই কাজটি যত বেশি সময় ধরে চলবে, তত জীবনের মূল্যবান সময় ও আনন্দ হারানো যাবে। তাই মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা জরুরি।

১২. কীভাবে মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে, তা কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো। [৫ নম্বর]

‘বোঝাপড়া’ কবিতায় মনের সঙ্গে আপোস বা মীমাংসার জন্য কবি নিম্নলিখিত পথগুলি বাতলেছেন:

  • **সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ:** জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন—ভালো বা মন্দ—তা মেনে নিতে হবে, কারণ ‘সবার তরে নহে সবাই’।
  • **অভিযোগ পরিহার:** যদি আঘাত আসে, তবে সেই ‘জাহাজ-ডুবি’র ঘটনা নিয়ে সবার সঙ্গে ঝগড়া না করে শান্ত থাকতে হবে।
  • **উদারতা অবলম্বন:** নিজেকে বা অপরকে নিজের মাপে মাপতে যাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং উদার হয়ে অপরের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়াতে হবে।
  • **আত্ম-পর্যালোচনা:** নিজের ব্যর্থতাকে মস্ত করে দেখে জীবনকে অন্ধকার করে তোলার অভ্যাসটি ত্যাগ করতে হবে (‘নিজের পায়েই কুড়ুল মারো’)।
  • **আলো জ্বালানো:** খুব খানিকটা কেঁদে নিয়ে, সমস্ত দুঃখের হিসেব চুকিয়ে দিয়ে (‘অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া’), মনের সঙ্গে আপোস করে অতীতের সব তফাৎ ভুলে জীবনের ‘প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো’।

রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (বিশেষ সংযোজন, মান: ৫ নম্বর):

১৩. ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক / সত্যেরে লও সহজে’—’বোঝাপড়া’ কবিতার এই মূল সুরটি তোমার নিজের ভাষায় আলোচনা করো। [৫ নম্বর]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটির মূল সুরটি হলো জীবনের প্রতি এক **গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি** এবং **বাস্তবতাকে সহজভাবে স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান**।

কবি মনকে উদ্দেশ্য করে বলছেন যে, এই পৃথিবীতে সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ—সবই স্বাভাবিক। জীবনে সবাই আমাদের ভালোবাসবে না, বা সবাই আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে না—এটাই চিরন্তন নিয়ম। এই সত্যটিকে সহজে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

কবিতায় এই মূল সুরের প্রকাশ তিনটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট:

  1. মানসিক প্রস্তুতি ও বৈচিত্র্য স্বীকার: কবি শুরুতেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ যেমন ভিন্ন, তেমনি তার আবেগও ভিন্ন। কেউ আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবে, কেউ বা নিঃস্বার্থ হবে। এই ভিন্নতাকে নিজের বা অন্যের দোষ না ভেবে, **জীবনের স্বাভাবিক গতি** হিসেবে মানতে হবে।
  2. বিপর্যয়ে স্থিরতা: জীবনের সুখের চূড়ান্তে হঠাৎ যদি কোনো বিপর্যয় আসে (যেমন, ‘জলের তলে পাহাড় ছিল / লাগল বুকের অন্দরেতে’), তবে তা নিয়ে আর্তনাদ বা ঝগড়া করে মরার চেয়ে **নিঃশব্দে সেই আঘাত সহ্য করে এগিয়ে যাওয়া** শ্রেয়।
  3. আত্ম-মীমাংসা ও নতুন পথে ফেরা: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা। কোনো ব্যক্তির প্রতি রাগ বা অভিমান (যাহার লাগি ‘অশ্রুসাগর’ বহিয়ে দেওয়া হয়েছে) কিংবা নিজের ব্যর্থতাকে বড়ো করে দেখার (নিজের ছায়া মস্ত করে) প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যখন মানুষ এই ক্ষতিকর অভ্যাসগুলি দ্রুত ত্যাগ করে, তখনই সে **জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য** ও বিশ্বভুবনের বিশালতা অনুভব করতে পারে।

এইভাবে কবি বারবার জোর দিয়েছেন যে, জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাই অতীতের ‘তফাৎ’ ভুলে গিয়ে **বর্তমানের প্রদীপ** জ্বালিয়ে তোলাই হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ ‘বোঝাপড়া’—যা এই কবিতার মূল মন্ত্র।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu