ষষ্ঠ পাঠ: পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি (নোট)
প্রসেসিং হচ্ছে…

বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)

ষষ্ঠ পাঠ: পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি (জীবনানন্দ দাশ) – নোটস ও উত্তর

**উৎস:** ধূসর পাণ্ডুলিপি (কাব্যগ্রন্থ) | **বিষয়বস্তু:** গ্রামীণ দুপুরের নির্জনতা, প্রকৃতি ও ইতিহাসচেতনার মিশ্রণ।

১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)

জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটি কবি-মানসের এক গভীর **নিসর্গপ্রীতি** এবং **ঐতিহ্যচেতনাকে** তুলে ধরে। কবি পাড়াগাঁয়ের দুপুরকে ভালোবাসেন, কারণ সেই সময়ে গ্রামের শান্ত প্রকৃতি, নির্জনতা এবং দীর্ঘদিনের ইতিহাস যেন মিশে থাকে।

মূল বক্তব্য:

  • **দু-পহরের আকর্ষণ:** কবি পাড়াগাঁয়ের দুপুরকে ভালোবাসেন, যখন চারিদিকে সবকিছু শান্ত থাকে। এই নির্জন দুপুরে কোনো কাজের ব্যস্ততা থাকে না, কেবল প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপে বিরাজ করে।
  • **ইতিহাস ও প্রকৃতি:** এই দুপুরে **’জানো-কি-বা না-জানো কোনো এক ব্যথা’** যেন কবির মনে ভিড় করে। এই ব্যথা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং এক প্রাচীন **ম্লান-শীতল ইতিহাস**-এর প্রতিচ্ছবি। কবি মনে করেন, হয়তো একদিন **’নাবিকেরা’** দূর দেশ থেকে এসে এই পাড়াগাঁয়ে আশ্রয় নিত।
  • **প্রকৃতির উপাদান:** দুপুরের প্রকৃতিতে রয়েছে: **ঘুঘুর ডাক**, বাতাসের মধ্যে **শিশির** ঝরে পড়ার শব্দ, **মৌমাছিরা** মধু নিয়ে উড়ে চলে, আর **পাণ্ডুলিপি-পাণ্ডুর শান্ত শিঙার মতো** শব্দ।
  • **উপলব্ধি:** এই নির্জন দুপুরের স্নিগ্ধতার মধ্যে কবি কেবল প্রকৃতিকে নয়, বরং **পুরোনো দিনের বেদনার** এক নিরুদ্দেশ ছায়া খুঁজে পান। তিনি **’নক্ষত্রের বিশীর্ণ পাতার মতো’** যা কিছু ক্ষীণ ও অস্পষ্ট, তাকেই ভালোবাসেন।

২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা

  • **দু-পহর:** দুপুর, মধ্যাহ্ন।
  • **পাণ্ডুলিপি:** পাণ্ডুর বা ফ্যাকাশে রং-এর পাণ্ডুলিপি বা পুঁথি।
  • **শিশির-ভেজা:** শিশির দ্বারা আর্দ্র বা ভিজে।
  • **শান্ত শিঙার মতো:** শিঙা হলো প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, যার শব্দ দূর থেকে ভেসে এলে এক বিষণ্ণতার আবহ সৃষ্টি করে।
  • **নাবিকেরা:** সমুদ্রপথে যারা যাতায়াত করে। এখানে অতীতের বিদেশী অতিথিদের প্রতীক।
  • **বিশীর্ণ:** ক্ষীণ, জীর্ণ বা শীর্ণ।
  • **নক্ষত্রের বিশীর্ণ পাতা:** কবি দ্বারা উদ্ভাবিত এক নতুন উপমা, যা নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল অথচ দুর্বল বা পুরাতন দিনের স্মৃতিকে বোঝায়।

৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)

(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):

১. ‘দু-পহর’ শব্দের অর্থ কী? [১ নম্বর]

‘দু-পহর’ শব্দের অর্থ হলো **দুপুর** বা মধ্যাহ্নকাল।

২. ‘ক্লান্ত কোনো ঘুম নেই’- বলতে কী বোঝানো হয়েছে? [২ নম্বর]

দুপুরে সাধারণত মানুষ ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, কিন্তু কবি এখানে এমন এক **সজাগ নির্জনতা** বা **নিস্তব্ধতা**-র কথা বলেছেন, যেখানে মানুষের বা প্রকৃতির কোনো **ক্লান্তি বা অবসাদ** নেই। এই নীরবতা যেন সতেজ ও প্রাণবন্ত।

৩. কবি কার আহ্বান শুনতে পান? [১ নম্বর]

কবি দুপুরের নিস্তব্ধতার মধ্যে **ঘুঘুর** আহ্বান শুনতে পান।

৪. কোন শব্দ কবিকে ঘুম-পারানিয়া রূপে আকর্ষণ করে? [২ নম্বর]

বাতাসের মধ্যে **শিশির ঝরে পড়ার শব্দ** কবিকে ঘুম-পারানিয়া রূপে আকর্ষণ করে। এই শব্দ অত্যন্ত স্নিগ্ধ ও মন-কেমন-করা অনুভূতি সৃষ্টি করে।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):

৫. ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’- কবি কেন পাড়াগাঁয়ের দুপুরকে ভালোবাসেন? [৩ নম্বর]

কবি পাড়াগাঁয়ের দুপুরকে ভালোবাসেন, কারণ এই সময়টিতে:

  • **নিঃসীম নির্জনতা:** থাকে এক শান্ত, স্নিগ্ধ **ক্লান্তহীন ঘুম**-এর মতো পরিবেশ, যেখানে প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ বজায় থাকে।
  • **ঐতিহ্যচেতনা:** এই নির্জনতা কবির মনে এক **ব্যথা** বা **ম্লান-শীতল ইতিহাস**-এর আভাস এনে দেয়, যা তাঁকে অতীত দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
  • **স্নিগ্ধতা ও মায়া:** এখানে মৌমাছিরা মধু নিয়ে উড়ে চলে, আর বাতাসের মধ্যে শিশির ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যায়, যা কবিকে **ঘুম-পারানিয়া সুর**-এর মতো আকর্ষণ করে।

৬. পাণ্ডুলিপি-পাণ্ডুর শান্ত শিঙার মতো’- ব্যাখ্যা করো। [৩ নম্বর]

এই পঙ্ক্তিতে কবি একটি সুন্দর চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন:

  • **পাণ্ডুলিপি-পাণ্ডুর:** ‘পাণ্ডুলিপি’ শব্দটি পুঁথি ও ইতিহাস এবং ‘পাণ্ডুর’ শব্দটি ফ্যাকাশে বা পুরোনো রং বোঝায়। এটি এক **পুরোনো দিনের জীর্ণতার** প্রতীক।
  • **শান্ত শিঙা:** ‘শিঙা’ এক ধরনের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, যার শব্দ দূর থেকে এলে মনকে বিষণ্ণ করে তোলে।
কবি পাড়াগাঁয়ের দুপুরের **বিষণ্ণ নিস্তব্ধতা** এবং অতীতের **বিস্মৃত ইতিহাসচেতনাকে** একসঙ্গে বোঝানোর জন্য এই উপমাটি ব্যবহার করেছেন। দুপুরের এই নির্জনতা যেন দূর থেকে ভেসে আসা পুরোনো, ম্লান হয়ে যাওয়া শিঙার শান্ত সুরের মতো।

৭. কবি কাদের ‘নক্ষত্রের বিশীর্ণ পাতার মতো’ বলে মনে করেছেন? এর দ্বারা তাঁর কোন মনোভাবের পরিচয় মেলে? [৩ নম্বর]

কবি **নাবিকদের** এবং **আদিম প্রকৃতির** সেই উপাদানগুলিকে, যারা এখন ক্ষয় হয়ে গেছে, ‘নক্ষত্রের বিশীর্ণ পাতার মতো’ বলে মনে করেছেন।
মনোভাব: এর মধ্য দিয়ে কবির **নস্টালজিয়া** এবং **ক্ষীয়মাণ সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা** প্রকাশ পায়। নক্ষত্রের পাতা ঝরে পড়ার উপমাটি দ্বারা কবি বোঝাতে চেয়েছেন, যা কিছু একসময় উজ্জ্বল ছিল, তা আজ **জীর্ণ, ক্ষীণ (বিশীর্ণ)** হয়ে গেলেও তার প্রতি কবির মমত্ববোধ কমেনি। তিনি **অতীতের ম্লান সৌন্দর্যের পূজারী**।

রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):

৮. ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’—কবিতাটিতে কীভাবে প্রকৃতির নির্জনতার সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনা মিশে গেছে, তা বিশ্লেষণ করো। [৫ নম্বর]

জীবনানন্দ দাশের ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ কবিতাটি নির্জন প্রকৃতি ও গভীর ঐতিহ্যচেতনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ:

  1. **প্রকৃতির নির্জনতা:** কবিতার শুরুতেই কবি পাড়াগাঁয়ের দুপুরের শান্ত, স্নিগ্ধ, **ক্লান্তহীন ঘুম**-এর মতো পরিবেশকে তুলে ধরেছেন। এই নির্জন দুপুরে শুধু **ঘুঘুর ডাক**, মৌমাছির ব্যস্ততা, এবং বাতাসের মধ্যে **শিশির ঝরে পড়ার** মতো শব্দ শোনা যায়। কবি এই নিসর্গকে তার **’ম্লান-শীতল’** রঙে দেখেছেন, যা তার শান্ত রূপের ইঙ্গিত দেয়।
  2. **ইতিহাসচেতনার অনুপ্রবেশ:** এই নিস্তব্ধতার মধ্যেই কবির মনে এক **’জানো-কি-বা না-জানো কোনো এক ব্যথা’** জেগে ওঠে। এই ব্যথা অতীতের। তিনি অনুমান করেন, দূর দেশ থেকে আসা **নাবিকেরা** হয়তো একসময় এই পাড়াগাঁয়ে আশ্রয় নিত। সেই প্রাচীনকালের মানুষের স্মৃতি যেন আজও এই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে।
  3. **উপমা ও চিত্রকল্প:** কবি পুরোনো দিনের স্মৃতিকে বোঝানোর জন্য **’পাণ্ডুলিপি-পাণ্ডুর শান্ত শিঙার মতো’** এবং **’নক্ষত্রের বিশীর্ণ পাতার মতো’** উপমাগুলি ব্যবহার করেছেন। এই চিত্রকল্পগুলি কেবল প্রকৃতির ছবি আঁকে না, বরং অতীত দিনের গৌরব ও ক্ষয়কে একইসঙ্গে ধরে রাখে।
  4. **একাত্মতা:** কবি এই দুপুরকে শুধু ভালোই বাসেন না, বরং সেই **’ম্লান-শীতল’** প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এই একাত্মতার কারণ হলো, পাড়াগাঁয়ের দুপুরের স্নিগ্ধতা কবির **ঐতিহ্য-অনুরাগী মনকে** অতীতের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

সুতরাং, এই কবিতাটিতে পাড়াগাঁয়ের নিস্তব্ধ দুপুর কবির কাছে এক **কালের জানালা**, যার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকৃতির বর্তমান রূপের মধ্যে অতীতের এক **বিস্মৃত ইতিহাস**-কে অনুভব করতে পারেন।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu