বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
পঞ্চম পাঠ: হাওয়ার গান (বুদ্ধদেব বসু) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** কাব্যগ্রন্থ | **বিষয়বস্তু:** হাওয়ার চিরন্তন নিঃসঙ্গতা, অস্থিরতা এবং অস্তিত্বের খোঁজে অবিরাম যাত্রা।
—১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
বুদ্ধদেব বসুর ‘হাওয়ার গান’ কবিতাটিতে হাওয়া বা বাতাসকে কেবল প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে নয়, বরং একটি **চেতনাযুক্ত সত্তা** হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। হাওয়াকে তার **’বাড়ি নেই’** বলে চিরকালের **নিঃসঙ্গ, গৃহহীন পথিক** রূপে দেখানো হয়েছে।
মূল বক্তব্য:
- **গৃহহীন হাওয়া:** হাওয়া চিরদিন বাইরে কেঁদে মরে। তার কোনো নির্দিষ্ট আশ্রয় বা ‘বাড়ি’ নেই। তাই তার নিঃশ্বাস **উত্তাল ও অস্থির**।
- **অবিরাম অনুসন্ধান:** হাওয়া **’সে কোথায়, সে কোথায়’** এই প্রশ্ন নিয়ে পৃথিবীর সব জল, সব তীর, পাহাড়, বন্দর, নগর, অরণ্য, প্রান্তর—সব পথে ঘুরেছে, কিন্তু তার **অনুসন্ধান বৃথা**।
- **জীবনের বৈপরীত্য:** যখন মানুষ তার শান্ত জীবনে—দোলনায়, কার্পেটে, স্বপ্নের মোমের আলোয়—আশ্রয় খুঁজে নেয়, ঠিক তখনই হাওয়া বাইরে **’বিদায় নেওয়া’** কোনো একজনের খোঁজ করে ফেরে।
- **চিরন্তন প্রশ্ন:** হাওয়া তার অনুসন্ধান শেষ করে না। সে জাহাজের মান্ডুলে, তরঙ্গের বুকে অবিরাম প্রশ্ন হানে। হাওয়া তার অস্তিত্বের গভীরে সেই **উত্তরহীন প্রশ্নটি** বয়ে বেড়ায়: **’নেই, নেই, দেখা নেই, নেই রে।’**
- **নিষ্ফল যাত্রা:** হাওয়া বারবার তার যাত্রাপথের পুনরাবৃত্তি করে, কিন্তু বারবার তার উত্তর মেলে না। ফলে তার **’জিজ্ঞাসা’** কখনও থামে না, সে কেবলই **’চারিদিকে শুধাই’**।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **উত্তাল:** তরঙ্গময়, উচ্ছ্বসিত, অত্যন্ত চঞ্চল।
- **অস্থির:** স্থির নয় এমন, চঞ্চল।
- **অরণ্য:** গভীর বনভূমি।
- **তেপান্তর:** বহু বিস্তৃত জনমানবহীন মাঠ, প্রান্তর (তিনটি প্রান্তরের সমাহার)।
- **ঝর্ঝর:** শুকনো পাতা ঝরে পড়ার শব্দ।
- **পঞ্জর:** পাঁজর, পাঁজরের হাড় বা বুকের কাঠামো।
- **নিস্বনে:** গর্জনে, শব্দে।
- **কাননের ক্রন্দনে:** বনের কান্না বা বনের মধ্য দিয়ে হাওয়ার চলার করুণ শব্দ।
- **মান্ডুলে:** জাহাজের মাস্তুলে বা পতাকাদণ্ডে (এখানে পথিকের গন্তব্যের প্রতীক)।
- **মত্ত আবর্তন:** উন্মত্ত বা তীব্রভাবে ঘুরতে থাকা।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. হাওয়াদের বাড়ি নেই, হাওয়াদের বাড়ি নেই, নেই রে।—এই উক্তির মধ্যে দিয়ে কবির কোন বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে?
এই উক্তিটির মধ্য দিয়ে কবি হাওয়ার **চিরন্তন গৃহহীনতা** ও **নিঃসঙ্গতা** প্রকাশ করেছেন। হাওয়া কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ী হতে পারে না, সে যেন জীবনের রহস্যময় প্রশ্নের খোঁজে এক **পথহারা পথিক**।
২. সারাদিন রাত্রির বুক চাপা কান্নায় নিশ্বাস ব’য়ে যায় উত্তাল, অস্থির—ব্যাখ্যা করো।
এখানে হাওয়াকে একটি **ব্যক্তি সত্তা** রূপে কল্পনা করা হয়েছে, যার হৃদয়ে যেন গভীর **ব্যথা** রয়েছে। চিরন্তন গৃহহীনতা এবং তার অনুসন্ধান ব্যর্থ হওয়ায়, তার সেই অব্যক্ত দুঃখই **উত্তাল ও অস্থির নিশ্বাস** (বাতাসের গতি) রূপে সারাদিন-সারারাত বয়ে চলে।
৩. হাওয়া কোথায় তার জিজ্ঞাসা কেবল শুধায়?
হাওয়া তার চিরন্তন জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন চারিদিকে শুধায়:
- পার্কের বেঞ্চিতে ঝরে-পড়া **ঝর্ঝর পাতা**-কে।
- জানলার **শার্সি** এবং দেয়ালের **পাঁজর**-কে।
- চিমনির **নিস্বনে** (গর্জন) এবং কাননের (বন)-এর **ক্রন্দনে**।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৪. হাওয়া কেন পৃথিবীর সব জল, সব তীর ছুঁয়ে গেছে? কেন তার এই যাত্রা বৃথা?
যাত্রার কারণ: হাওয়া **’সে কোথায়, সে কোথায়’**—এই গভীর ও রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং তার কাঙ্ক্ষিত আশ্রয় খুঁজে পেতে পৃথিবীর সমস্ত স্থান—জল, তীর, নগর, পাহাড়, অরণ্য, প্রান্তর—অবিরাম ছুঁয়ে গেছে।
যাত্রা বৃথা কেন: এত কিছু খুঁজেও হাওয়া তার প্রশ্নের উত্তর পায়নি, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি, তাই তার এই **দীর্ঘ ও দুর্বার যাত্রা ব্যর্থ** হয়েছে।
৫. হাওয়া যখন অবিরাম প্রশ্ন হানে, তখন মানুষ কী করে? জীবনের এই বৈপরীত্যের কারণ কী?
হাওয়া যখন তরঙ্গের বুকে **’অবিরাম নর্তন, মত্ত আবর্তন’** দ্বারা প্রশ্ন হানে, তখন মানুষ তার শান্ত ও স্বস্তিময় জীবনে মগ্ন থাকে।
- মানুষেরা দোলনায় ঘুম যায়, কুকুরের তন্দ্রা নামে কার্পেটে।
- ঘরে ঘরে স্বপ্নের **মৃদু মোম জ্বলে**।
- জাহাজের যাত্রীরা সিনেমায় যায় বা নাচে-গান গায়।
৬. ‘আমরা তরঙ্গের বুকে হানি প্রশ্নের/ অবিরাম নর্তন, মত্ত আবর্তন-‘- ব্যাখ্যা করো।
আলোচ্য পঙ্ক্তি দুটিতে হাওয়াকে এক **অস্থির অনুসন্ধিৎসু সত্তা** রূপে দেখানো হয়েছে।
- **অবিরাম নর্তন ও আবর্তন:** হাওয়া সমুদ্রের তরঙ্গের উপর তার গতিময়তা ও ঘূর্ণনকে সঞ্চারিত করে, যা তার **আবেগের তীব্রতা** নির্দেশ করে।
- **প্রশ্নের আঘাত:** এই তীব্র গতি বা নর্তন আসলে হাওয়া কর্তৃক **অস্তিত্বের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া চিরন্তন প্রশ্ন**—’সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে’—যা তরঙ্গের উপর আঘাত হানার (হানির) মতো।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৭. ‘হাওয়াদের বাড়ি নেই’—কবিতা অবলম্বনে হাওয়ার গৃহহীনতার মধ্যে দিয়ে যে গভীর জীবনবোধ প্রকাশ পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করো।
বুদ্ধদেব বসুর ‘হাওয়ার গান’ কবিতায় হাওয়াকে গৃহহীন, অস্থির এবং চিরন্তন অনুসন্ধানের প্রতীক রূপে দেখানো হয়েছে, যা এক গভীর জীবনবোধ বহন করে:
- **অস্তিত্বের সংকট:** হাওয়ার ‘বাড়ি নেই’—এই কথাটি কেবল প্রাকৃতিক সত্য নয়, বরং মানব চেতনার এক গভীর সংকটের প্রতীক। হাওয়া যেন মানব মনের সেই **অস্থিরতা** যা কোনো জাগতিক ঠিকানায় তৃপ্ত হতে পারে না।
- **চিরন্তন অনুসন্ধান:** হাওয়া কেবল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে চলে না, সে **’সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে’**—এই রহস্যময় প্রশ্ন নিয়ে অবিরাম ঘুরে বেড়ায়। এই অনুসন্ধান সেই কাঙ্ক্ষিত **পরম সত্য** বা জীবনের **চূড়ান্ত আশ্রয়ের** খোঁজ, যা সমস্ত জাগতিক নগর, বন্দর, অরণ্য, প্রান্তর খুঁজেও মেলে না।
- **নিঃসঙ্গতার প্রকাশ:** হাওয়া যখন দেখে মানুষজন শান্ত জীবনে ‘দোলনায় ঘুম যায়’ বা ‘স্বপ্নের মৃদু মোম’ জ্বালিয়ে থাকে, তখন হাওয়ার গৃহহীনতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এই নিঃসঙ্গতা যেন কবির আত্মিক **গভীর বেদনার** প্রতিফলন।
- **অবিরাম বিদ্রোহ:** হাওয়া তার অনুসন্ধান ব্যর্থ হলেও থামে না। সে তার **’বুক-চাপা কান্না’** বা অস্থিরতাকে **’অবিরাম নর্তন, মত্ত আবর্তন’** দ্বারা প্রকাশ করে, যা হার মানতে না চাওয়ার এক **দুর্মর জীবনশক্তিকে** বোঝায়।
তাই হাওয়ার এই গৃহহীনতা আসলে সেই দার্শনিক বোধের জন্ম দেয় যে, **অস্থিরতা ও অনুসন্ধানই জীবনের মূল ধর্ম**, আর জাগতিক আরামের বাইরে এই **অবিরাম যাত্রা**-ই অস্তিত্বের মহৎ প্রকাশ।