বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
পঞ্চম পাঠ: গাছের কথা (জগদীশচন্দ্র বসু) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** অব্যক্ত (প্রবন্ধ গ্রন্থ) | **বিষয়বস্তু:** উদ্ভিদের জীবনবোধ ও মানুষের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য।
—১. প্রবন্ধ পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু রচিত ‘গাছের কথা’ প্রবন্ধটি তার যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সহজ ও সাহিত্যিক ভাষায় পরিবেশন করেছে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখক প্রমাণ করেছেন, **গাছের জীবন মানুষের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি**।
মূল বক্তব্য:
- **জীবনের উপলব্ধি:** লেখক প্রথমে মনে করতেন গাছেরা নীরব ও নিষ্প্রাণ। কিন্তু পরে ভালোবাসা ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করেন যে গাছেরা অনুভব করে, দিন দিন বাড়ে এবং তাদের মধ্যে **সুখ-দুঃখ, অভাব-কষ্ট** রয়েছে।
- **মানুষের সাদৃশ্য:** গাছের মধ্যেও চুরি-ডাকাতি (জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম), **বন্ধুত্ব, একে অন্যকে সাহায্য করা** এবং **স্বার্থত্যাগ**-এর মতো মানবিক গুণাবলি দেখা যায়। মা যেমন সন্তানের জন্য জীবন দেন, উদ্ভিদেও তেমন স্বার্থত্যাগ লক্ষ্য করা যায়।
- **বীজ ও জীবনচক্র:** বীজকে লেখক ‘গাছের ডিম’ বা **’বৃক্ষশিশু’**-র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা উত্তাপ, জল ও মাটি পেলে জন্ম নেয়। বীজের কঠিন ঢাকনা সেই ঘুমন্ত শিশুটিকে বিপদ থেকে রক্ষা করে।
- **বীজ বিস্তারণ:** নানা উপায়ে গাছের বীজ ছড়িয়ে পড়ে—পাখিরা ফল খেয়ে বীজ দূরে বহন করে, শিমুলের তুলা বাতাসের মাধ্যমে বীজকে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে দেয়।
- **পৃথিবী মাতার ভূমিকা:** লেখক বলেছেন, গাছ যেখানেই পড়ুক, **’পৃথিবী মাতার ন্যায় তাহাকে কোলে তুলিয়া লইলেন’**, যা বিশ্বপ্রকৃতির এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরে।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **আহার:** খাদ্য, খাবার।
- **সদ্গুণ:** ভালো বা উত্তম গুণ।
- **স্বার্থত্যাগ:** নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া (Self-sacrifice)।
- **অঙ্কুর:** বীজ থেকে নতুন চারাগাছের বের হওয়া অংশ।
- **বৃক্ষশিশু:** গাছের শিশু (বীজের মধ্যে ঘুমন্ত চারা)।
- **জনমানবশূন্য:** যেখানে মানুষজন নেই এমন স্থান।
- **দেশ-দেশান্তরে:** এক দেশ থেকে অন্য দেশে, বহু দূর দূরান্তে।
- **বিধাতা:** সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. লেখক কবে থেকে গাছদের অনেক কথা বুঝতে পারেন?
গাছ, পাখি ও কীটপতঙ্গদের **ভালোবাসতে শেখার পর** থেকে লেখক তাদের অনেক কথা বুঝতে পারেন।
২. জীবিতের লক্ষণ কী তা লেখক অনুসরণে উল্লেখ করো।
লেখকের মতে, **জীবিত বস্তু ক্রমশ বাড়ে** এবং তার **গতি বা নড়াচড়া** করার ক্ষমতা থাকে।
৩. ‘বৃক্ষশিশু নিরাপদে নিদ্রা যায়।’ বৃক্ষশিশু কোথায় নিদ্রা যায়?
বৃক্ষশিশু **বীজের উপরকার কঠিন ঢাকনার** মধ্যে নিরাপদে নিদ্রা যায়।
৪. অঙ্কুর বের হবার জন্য কী কী প্রয়োজন?
বীজ থেকে অঙ্কুর বের হবার জন্য **উত্তাপ (তাপ), জল ও মাটি** এই তিনটি উপাদানের প্রয়োজন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৫. ‘ইহাদের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু দেখা যায়।’ কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের মধ্যে কী লক্ষ করা যায়?
এখানে **গাছপালা বা উদ্ভিদদের** কথা বলা হয়েছে।
তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত মানবিক গুণাবলি দেখা যায়:
- **জীবনধারণের সংগ্রাম:** জীবিকা ধারণের জন্য চুরি-ডাকাতি বা ব্যস্ততা।
- **সামাজিক গুণ:** একে অন্যকে **সাহায্য** করা এবং **বন্ধুত্ব** তৈরি হওয়া।
- **স্বার্থত্যাগ:** সন্তানের জীবন রক্ষার জন্য মায়ের নিজের জীবনদানের মতো, উদ্ভিদেও **স্বার্থত্যাগ** দেখা যায়।
৬. ‘গাছের জীবন মানুষের ছায়ামাত্র।’ লেখকের এমন উক্তি অবতারণার কারণ বিশ্লেষণ করো।
উদ্ভিদ জীবনে মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়ার জন্যই লেখক এমন মন্তব্য করেছেন। কারণ:
- মানুষের মতোই গাছেরও **অভাব, দুঃখ-কষ্ট** রয়েছে এবং জীবনধারণের জন্য তাদেরও সর্বদা **ব্যস্ত** থাকতে হয়।
- গাছের মধ্যে মানুষের মতো **সদ্গুণ**—যেমন বন্ধুত্ব, সাহায্য করা এবং সর্বোচ্চ গুণ **স্বার্থত্যাগও** দেখা যায়।
অর্থাৎ, মানুষের মতো করেই গাছেরা তাদের জীবন যাপন করে এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি দেখায়—তাই গাছের জীবনকে মানুষের জীবনের ছায়া বলা হয়েছে।
৭. ‘নানা উপায়ে গাছের বীজ ছড়াইয়া যায়।’- উপায়গুলি পাঠ্যাংশ অনুসরণে আলোচনা করো।
প্রবন্ধে উল্লিখিত বীজ ছড়ানোর উপায়গুলি নিচে দেওয়া হলো:
- **পাখিদের দ্বারা:** পাখিরা ফল খেয়ে বীজ দূর দেশে নিয়ে যায়। এভাবেই জনমানবশূন্য দ্বীপেও গাছ জন্মায়।
- **বাতাসের দ্বারা:** শিমুল ফল পেকে ফেটে গেলে বীজগুলি তুলার সঙ্গে উড়তে থাকে। প্রবল বাতাসের বেগে বীজ অনেক দূর দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
- **মানুষের দ্বারা:** কৃষক বা সাধারণ মানুষও ধান, যব-এর মতো বীজ ক্ষেতে ছড়ায় বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৮. ‘পৃথিবী মাতার ন্যায় তাহাকে কোলে লইলেন।’—প্রবন্ধে জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্ভিদের জীবনবোধ ও পৃথিবীর ভূমিকা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির আলোচনা করো।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু এই প্রবন্ধের মাধ্যমে উদ্ভিদ জীবনকে এক **সংবেদনশীল সত্তা** হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং প্রকৃতিতে **সহানুভূতি ও ভালোবাসার** সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
- **জীবনের সংগ্রাম:** লেখক প্রথম উপলব্ধি করেন যে গাছও প্রাণীর মতোই আহার করে, বাড়ে, এবং অভাব-কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে। গাছের মধ্যে বন্ধুত্ব, সাহায্য ও স্বার্থত্যাগের মতো মানবিক গুণাবলিও রয়েছে।
- **বীজের ভূমিকা (বৃক্ষশিশু):** বীজকে লেখক **’বৃক্ষশিশু’** বলেছেন, যা তার কঠিন আবরণের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে। বীজ থেকে গাছ জন্মানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ—অর্থাৎ উত্তাপ, জল ও মাটি—অত্যাবশ্যক।
- **পৃথিবী মাতার স্নেহ:** বীজ যখন প্রবল ঝড়-বাতাসে উড়ে গিয়ে ভাঙা ইট বা মাটির ডেলার নীচে আশ্রয় নেয়, তখন তা মানুষের চোখ থেকে আড়াল হলেও **বিধাতার দৃষ্টির বাইরে যায় না**। সেই সময় **’পৃথিবী মাতার ন্যায় তাহাকে কোলে তুলিয়া লইলেন’**। মা যেমন তার সন্তানকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন, পৃথিবীও তেমনি শীত-ঝড় থেকে বীজকে আড়াল করে রাখে।
এই উক্তিটির মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, **মানুষ ও উদ্ভিদের জীবনবোধ একই**, আর **মাতৃরূপী প্রকৃতি** সেই জীবনকে লালন করে। এই সংবেদনশীলতাই জগদীশচন্দ্র বসুর প্রবন্ধের মূল ভিত্তি।