বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
চতুর্থ পাঠ: ছন্নছাড়া (অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** কাব্যগ্রন্থ | **বিষয়বস্তু:** বেকারত্ব, সামাজিক বঞ্চনা, যুব বিদ্রোহ ও জীবনের জয়গান।
—১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
‘ছন্নছাড়া’ কবিতাটি একটি বিশেষ সমাজবাস্তবতা ও **যুব-বিদ্রোহের** দলিল। কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এক গলির মোড়ে **’ছন্নছাড়া’** কিছু বেকার যুবকের আড্ডা এবং একটি শুকনো গাছের বর্ণনা দিয়ে কবিতাটি শুরু করেছেন।
মূল বক্তব্য:
- **প্রারম্ভিক বৈপরীত্য:** গলির মোড়ের **শুকনো গাছটি** (প্রেতচ্ছায়া) এবং সেখানে আড্ডা দেওয়া **বেকার যুবকের দল**—দুজনেই সমাজের বঞ্চনা ও রিক্ততার প্রতীক।
- **’নেই রাজ্যের’ বাসিন্দা:** ট্যাক্সি ড্রাইভারের সংলাপে যুবকদের সামাজিক পরিচয় উঠে আসে। তারা **’বিরাট এক নৈরাজ্যের—এক নেই রাজ্যের বাসিন্দা’**। তাদের জীবন কলেজ সিট, চাকরি, ট্রামে জায়গা, হাসপাতালে বেড—সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।
- **বাস্তব উদাহরণ:** যুবকদের সামনে জীবনের একমাত্র উদাহরণ হলো **’সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ’** বা ‘নিজের দিকে ঝোল-টানা’র মতো স্বার্থপরতা।
- **মানবিকতার জয়:** যখন তারা গাড়িচাপা পড়া এক বেওয়ারিশ ভিখারিকে উদ্ধার করতে ট্যাক্সি খোঁজে, তখন তাদের ভেতরের **মানবিক প্রাণশক্তি** প্রকাশ পায়।
- **জীবনের শঙ্খধ্বনি:** সেই মুহূর্তেই **শুকনো গাছটি** কচি সোনালী পাতায় ভরে ওঠে, যা যুবকদের ভেতরের **’প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে’**—এই প্রত্যয়েরই প্রতীক। কবিতা শেষে তাই **’ক্ষয়হীন আশা’** ও **’মৃত্যুহীন মর্যাদা’**-র জয়গান করা হয়েছে।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **প্রেতচ্ছায়া:** প্রেত বা পিশাচের ছায়া। এখানে **শুষ্ক ও নির্জীব** গাছের প্রতীক।
- **ছন্নছাড়া:** বাউন্ডুলে, লক্ষ্যহীন, ছিন্নভিন্ন।
- **নৈরাজ্য:** যেখানে কোনো আইন, কানুন বা ব্যবস্থা নেই (Anarchy)।
- **সুধাক্ষরণ:** অমৃত নিঃসরণ বা ভালো কিছু দেওয়া।
- **ক্ষুধাহরণ:** ক্ষুধা দূর করা বা অভাব মেটানো।
- **স্ফুলিঙ্গ-হীন ভিজে বারুদের স্তূপ:** ভেজা বারুদে যেমন আগুন জ্বলে না, তেমনি বেকার ও বঞ্চনার শিকার যুবকদের মধ্যে থাকা **অসামান্য প্রাণশক্তি** সমাজের কারণে অব্যবহৃত।
- **স্নেহার্দ্র:** স্নেহ দ্বারা আর্দ্র বা সিক্ত।
- **প্রত্যয়:** দৃঢ় বিশ্বাস বা আস্থা।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. কবি প্রথমে গাছটিকে কেমন অবস্থায় দেখেছিলেন?
কবি প্রথমে গাছটিকে **আঁকাবাঁকা শুকনো কাঠির কঙ্কাল** রূপে, লতা-পাতা-ছায়া-ছালবাকলহীন **’গাছের প্রেতচ্ছায়া’** হিসেবে দেখেছিলেন।
২. ‘ড্রাইভার বললে, ওদিকে যাব না।’ ওদিকে না যেতে চাওয়ার কারণ কী?
ড্রাইভার ওদিকে যেতে চায়নি, কারণ গলির মোড়ে **চোঙা প্যান্ট ও চোখা জুতো পরা** ছন্নছাড়া বেকার ছোকরারা আড্ডা দিচ্ছিল। ড্রাইভারের ভয় ছিল, তারা গাড়ি থামিয়ে **’হাওয়া খাওয়ানোর’** নামে লিফট চাইবে।
৩. ‘কারা ওরা?’ – কবিতা অনুসরণে ওদের পরিচয় দাও?
ওরা হলো **সমাজের ব বঞ্চিত, বেকার যুবকের দল**। তারা **’বিরাট এক নৈরাজ্যের—এক নেই রাজ্যের বাসিন্দা’**। তাদের জীবন থেকে ভিটে, ভিত, নীতি, চাকরি, জায়গা, সম্মান—সব কিছুই লোপাট হয়ে গেছে।
৪. ‘আমি নেমে পড়লুম তাড়াতাড়ি’- কবি তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন কেন?
বেওয়ারিশ ভিখারির দলা পাকানো রক্তে-মাংসে মাখামাখি শরীরটি যখন ট্যাক্সির মধ্যে তোলা হলো, তখন সেই **রক্তের দাগ থেকে নিজের ভব্যতা ও শালীনতাকে বাঁচাতে** গিয়ে কবি তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়েছিলেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৫. ‘ঘেঁষবেন না ওদের কাছে।’ এই সাবধানবাণী কে উচ্চারণ করেছেন? কেন তিনি এই পরামর্শ দিলেন?
এই সাবধানবাণীটি **ট্যাক্সি ড্রাইভার** উচ্চারণ করেছেন।
পরামর্শের কারণ: ড্রাইভারের মতে, এই ছন্নছাড়া যুবকরা সমাজের আইন-কানুন বা **নীতি-ভদ্রতা** কিছুই মানে না। তারা **’নেই রাজ্যের বাসিন্দা’** এবং তাদের মেজাজ **রোখা**। ড্রাইভারের আশঙ্কা, ওদের কাছে গেলেই এরা জোর করে গাড়িতে উঠে লিফট চাইবে বা ঝামেলা করবে। আসলে, এই যুবকরা সমাজের চোখে ভয়ংকর ও অস্পৃশ্য, তাই ড্রাইভার এই পরামর্শ দিয়েছিলেন।
৬. ‘তাই এখন এসে দাঁড়িয়েছে সড়কের মাঝখানে।’ এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের এমন পরিণতির কারণ কী?
এখানে **ছন্নছাড়া বেকার যুবকদের** কথা বলা হয়েছে।
পরিণতির কারণ: তাদের এমন পরিণতির কারণ হলো সমাজের **সুযোগ ও সম্পদের বঞ্চনা**।
- তাদের জন্য **কলেজে সিট নেই, অফিসে চাকরি নেই, কারখানায় কাজ নেই**।
- তাদের জীবন **’ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ’** পায়নি, পেয়েছে শুধু ‘নিজের দিকে ঝোল-টানা’র মতো স্বার্থপরতার উদাহরণ।
- তাদের মধ্যবিত্ত বাড়ির **’এক চিলতে ফালতু এক রক’**-ও লোপাট হয়ে গেছে।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৭. কবিতায় ‘গাছটি’ কীভাবে প্রাণের প্রতীক হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করো। যুবকদের মানবিক সংকল্পের সঙ্গে গাছটির পুনর্জীবনের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করো।
গাছের প্রতীকি ভূমিকা: কবিতার শুরুতে গলির মোড়ের গাছটি ছিল **রিক্ততা ও বঞ্চনার প্রতীক**। এটি ছিল ‘আঁকাবাঁকা শুকনো কাঠির কঙ্কাল’ বা ‘প্রেতচ্ছায়া’, যা বঞ্চনার শিকার **যুবকদের জীবনের রিক্ততার** সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ।
পুনর্জীবনের সম্পর্ক: যুবকরা যখন নিজেদের সামাজিক বঞ্চনা (নেই রাজ্যের বাসিন্দা) ভুলে **মানবতার চরম উদাহরণ** তৈরি করল—গাড়ি চাপা পড়া এক বেওয়ারিশ ভিখারিকে বাঁচাতে সোল্লাসে ট্যাক্সি খুঁজতে শুরু করল—তখন তাদের ভেতরের সুপ্ত **প্রাণশক্তি** জাগ্রত হলো। এই মানবিক সংকল্পের মুহূর্তেই:
- শুকনো গাছটি বিদীর্ণ করে **হাজার হাজার সোনালী কচি পাতা** বেরিয়ে এলো।
- গাছটিতে **ফুল উথলে উঠলো** এবং **রং-বেরঙের পাখি** এসে কলকণ্ঠের কাকলি শুরু করলো।
এই **গাছের পুনর্জীবন** প্রতীকীভাবে যুবকদের ভেতরের **’প্রাণ’** এবং **’ক্ষয়হীন আশা’**-র জাগরণকে চিহ্নিত করে। যখন তারা সামাজিক স্বার্থপরতা (‘নিজের দিকে ঝোল-টানা’) থেকে মুক্ত হয়ে নিঃস্বার্থ মানবিক কাজ করে, তখনই তাদের জীবনের **’মৃত্যুহীন মর্যাদা’** প্রতিষ্ঠিত হয়, যারই প্রাকৃতিক প্রতিফলন এই গাছটি। তাই গাছটি হলো **আশা, মর্যাদা ও জীবনের অপরিহার্য শক্তির** প্রতীক।
৮. ‘প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে।’—এই দুর্মর আশাবাদের ‘তপ্ত শঙ্খধ্বনি’ কবিতায় কীভাবে বিঘোষিত হয়েছে তা আলোচনা করো।
‘তপ্ত শঙ্খধ্বনি’র তাৎপর্য: ‘প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে’—এই উক্তিটি হলো কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের **দুর্মর আশাবাদ**। এই আশাবাদ কোনো শান্ত ঘোষণা নয়, বরং **’দুর্বার উচ্চারণ’** এবং **’তপ্ত শঙ্খধ্বনি’**। শঙ্খধ্বনি সাধারণত শুভ ও পবিত্র কিছুর সূচনা করে, আর ‘তপ্ত’ শব্দটি সেই সংকল্পের দৃঢ়তা ও আবেগকে বোঝায়।
যেভাবে বিঘোষিত: এই আশাবাদ দু’টি স্তরে বিঘোষিত হয়েছে:
- **মানবিক সংকল্পের স্তরে:**
- যুবকরা যখন **বেওয়ারিশ ভিখারিকে** বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তাদের কণ্ঠে সোল্লাসে শোনা যায় **’প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে’**।
- এই কাজ প্রমাণ করে, সমাজের সমস্ত বঞ্চনা, বেকারত্ব, এবং ‘নেই রাজ্যের’ রিক্ততার মধ্যেও যুবকদের অন্তরে **মানবিক মূল্যবোধ** মরে যায়নি।
- **প্রাকৃতিক পুনর্জীবনের স্তরে:**
- এই মানবিক সংকল্পের পরই **জীর্ণ, শুকনো গাছটি** মুহূর্তের মধ্যে **সোনালী কচি পাতায়** ভরে ওঠে।
- এই অলৌকিক প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রমাণ করে, যুবকদের মানবিকতা হলো **জীবনের মূল মন্ত্র**। যেখানে প্রাণ ও প্রেম আছে, সেখানে সমস্ত বাধানিষেধের বাইরেও **’অস্তিত্বের অধিকার’** ও **’মৃত্যুহীন মর্যাদা’** নিশ্চিত।
অর্থাৎ, **নিঃস্বার্থ প্রেম ও মানবিক কাজই** হলো সেই শঙ্খধ্বনি, যা জীবনের চরম সত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে: **প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ**।