বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
চতুর্থ পাঠ: পল্লীসমাজ (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** পল্লীসমাজ (উপন্যাস) | **বিষয়বস্তু:** গ্রাম্য জমিদারতন্ত্র, মানবতা এবং সামাজিক স্বার্থপরতার দ্বন্দ্ব।
—১. গল্প পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক মাইলফলক। আলোচ্য অংশটিতে শরৎচন্দ্র গ্রামীণ সমাজের **জমিদার শ্রেণি এবং সাধারণ কৃষকের জীবন-জীবিকার** দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
মূল বক্তব্য:
- **সংকট:** অবিরাম বৃষ্টিপাতের ফলে গ্রামের ‘একশো বিঘের মাঠ’ ডুবে যাওয়ায় কৃষকদের ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। জল বের করার একমাত্র পথ হলো জমিদার **বেণীবাবু ও রমার** যৌথ বাঁধটি কেটে দেওয়া।
- **স্বার্থপরতা:** বেণীবাবু তাঁর নিজের **দু-তিনশো টাকার মাছের লোকসান** বাঁচাতে গিয়ে হাজার হাজার টাকার ধান নষ্ট হতে দিতেও রাজি, যা তাঁর নির্দয় ও শোষণমূলক মানসিকতার পরিচয় দেয়।
- **মানবিকতা:** গ্রামের হিতাকাঙ্ক্ষী যুবক **রমেশ** কৃষকদের হয়ে জমিদার বেণীবাবু ও রমার কাছে আর্জি জানায়, কিন্তু প্রথমে রমাও বেণীবাবুর মতো ব্যক্তিগত লোকসানের অজুহাতে বাঁধ কাটতে অস্বীকার করে।
- **প্রতিবাদ ও সংকল্প:** অপমানিত ও ক্রুদ্ধ রমেশ নিজের উদ্যোগে বাঁধ কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার এই মানবিক সংকল্পে বাধা দিতে বেণীবাবুর লোক **আকবর আলি** এলেও, রমেশের তেজে এবং যুক্তিতে সে পরাজিত হয়ে সরে যায়।
- **ফলাফল:** শেষ পর্যন্ত রমেশের **মানবিক জয়** হয়। রমা তার নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং আকবর আলিও রমেশের মহত্ত্বের কাছে মাথা নত করে।
এই গল্পাংশে লেখক দেখিয়েছেন, শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তির **দৃঢ় মানবিকতা** ও সংকল্প কীভাবে সমাজকে বাঁচাতে পারে।
—২. প্রধান চরিত্র বিশ্লেষণ
- **রমেশ:** গ্রামের হিতাকাঙ্ক্ষী যুবক জমিদার। সে **সৎ, নির্ভীক ও মানবতাবাদী**। সে ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করেও কৃষকদের বাঁচাতে চায়। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সে নিজের হাতে বাঁধ কেটে দেওয়ার মতো সাহসী পদক্ষেপ নেয়।
- **বেণীবাবু:** গ্রামের প্রভাবশালী জমিদার। তিনি **স্বার্থপর, নির্দয় ও শোষক** প্রকৃতির। নিজের সামান্য লাভের জন্য তিনি হাজার হাজার কৃষকের অন্ন মারতে দ্বিধা করেন না। তাঁর চরিত্রে জমিদারতন্ত্রের সব খারাপ দিকগুলি ফুটে উঠেছে।
- **রমা:** সম্পত্তির অংশীদার। প্রথমদিকে সেও বেণীবাবুর মতো **স্বার্থ ও হিসাবের** ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কিন্তু রমেশের অপমান ও যুক্তির পর, এবং রমেশের সাহসিকতা দেখার পর তার **মানবতাবোধ জাগ্রত** হয়।
- **আকবর আলি:** বেণীবাবুর লাঠিয়াল প্রজা। সে অনুগত হলেও **সততা ও সাহস** তার চরিত্রে ছিল। রমেশের মানবিক তেজ ও মহত্ত্বের কাছে সে শেষ পর্যন্ত মাথা নত করে।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. গ্রামের একমাত্র ভরসা কী ছিল?
গ্রামের কৃষকদের জীবন-জীবিকার একমাত্র ভরসা ছিল **একশো বিঘের মাঠটি**, যেখানে সমস্ত চাষিদের কিছু কিছু জমি ছিল।
২. ‘বোধ করি এই কথাই হইতেছিল’- কোন্ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে?
এই কথা বলতে জমিদার **বেণীবাবু ও হালদার মহাশয়ের** মধ্যে জলার বাঁধটি না কেটে **মাছের লোকসান বাঁচানোর** বিষয়ে যে আলোচনা চলছিল, তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
৩. রমা আকবরকে কোথায় পাহারা দেবার জন্য পাঠিয়েছিল?
রমা আকবরকে **জলার বাঁধটি পাহারা** দেবার জন্য পাঠিয়েছিল, যাতে রমেশ এসে সেটি কেটে দিতে না পারে।
৪. ‘পারবি নে কেন?’ উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কোন্ কাজটি করতে পারবে না?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি **আকবর আলি** বেণীবাবুর অনুরোধ সত্ত্বেও **মিথ্যা মামলা** দায়ের করে রমেশকে হাজতে পুরতে পারবে না। কারণ, এতে তার ‘সর্দার’ হিসেবে সম্মান বা ‘সরম’ নষ্ট হবে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৫. বেণী জল বার করতে চায়নি কেন?
জমিদার বেণীবাবু অত্যন্ত **স্বার্থপর ও লোভী** প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বাঁধ কেটে দিলে তাঁর জলায় থাকা মাছগুলি বেরিয়ে যাবে, যার ফলে তাঁর **দু-তিনশো টাকার লোকসান** হবে। নিজের এই সামান্য ক্ষতি বাঁচাতে তিনি হাজার হাজার কৃষকের সারা বছরের অন্ন নষ্ট হতে দিতেও রাজি ছিলেন এবং সেই ধান নষ্ট হলে কৃষকেরা আবার তাঁর কাছেই ধার চাইতে আসবে—এই সুযোগ কাজে লাগানোর মানসিকতাও তাঁর মধ্যে ছিল। এই কারণেই তিনি জল বার করতে চাননি।
৬. ‘রমেশ বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেল’ রমেশের বিস্ময়ের কারণ কী ছিল?
রমেশ অত্যন্ত মানবিক আবেগে রমার কাছে গ্রামের কৃষকদের বাঁচানোর জন্য বাঁধ কেটে দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিল। রমেশের নিশ্চিত ধারণা ছিল, তার **একান্ত অনুরোধ রমা কিছুতেই প্রত্যাখান করতে পারবে না**। কিন্তু রমা যখন বেণীবাবুর মতোই **ক্ষতিপূরণের দোহাই দিয়ে** বাঁধ কাটতে অসম্মতি জানায়, তখন রমেশের সেই প্রত্যাশা ভেঙে যায়। রমার কাছ থেকে এমন **নিষ্ঠুর, হিসাব-করা উত্তর** আশা না করায় সে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল।
৭. ‘মানুষ খাঁটি কি না, চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে’ কে, কার সম্পর্কে একথা বলেছিল? সে কেন একথা বলেছিল?
এই উক্তিটি **রমেশ** তার শৈশবের বন্ধু **রমাকে** উদ্দেশ্য করে বলেছিল।
কারণ: রমা যখন কৃষকদের বাঁচানোর বিনিময়ে নিজেদের **দুশো টাকার ক্ষতি স্বীকার** করতে চায়নি, বরং রমেশের মানবিক দুর্বলতা দেখে তাকেই ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল, তখন রমেশ বুঝতে পারে যে টাকার সম্পর্কে রমা তার **আসল, ছোটো রূপটি** প্রকাশ করে দিয়েছে। রমেশের কাছে মানুষ হিসেবে রমার যে উচ্চ ধারণা ছিল, তা ভেঙে যায়—তাই সে এমন মন্তব্য করে।
৮. ‘মোরা নালিশ করতি পারব না’ কে একথা বলেছে? সে নালিশ করতে পারবে না কেন?
এই কথাটি বেণীবাবুর লাঠিয়াল প্রজা **আকবর আলি** বলেছে।
আকবর নালিশ করতে পারবে না, কারণ:
- **আত্মমর্যাদাবোধ:** পাঁচখানা গ্রামের লোকে তাকে **সর্দার** বলে ডাকে। সে জমিদার বেণীবাবুর কথায় মিথ্যা অজুহাতে সগৌরবে দাঁড়ানো রমেশের বিরুদ্ধে নালিশ করে **’ফৈরিদি’** (বাদী) হয়ে নিজের সম্মান বা ‘সরম’ নষ্ট করতে চায়নি।
- **রমেশের মহত্ত্ব:** সে রমেশের **সাহস, তেজ ও মানবিকতা** দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। রমেশ তার নিজের গাঁয়ের জমিজমা নষ্ট হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানবিক আবেদন জানালে আকবর লজ্জিত হয়। তাই সে সর্দারি বজায় রাখতে রমেশের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারেনি।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৯. বেণী, রমা ও রমেশ—চরিত্র তিনটির তুলনামূলক আলোচনা করো। এই তিনজনের মধ্যে কোন চরিত্রটি তোমার সবথেকে ভালো লেগেছে এবং কেন?
আলোচ্য গল্পাংশে জমিদার পরিবারের তিনজনের চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী:
| চরিত্র | বৈশিষ্ট্য |
|---|---|
| **বেণীবাবু** | **স্বার্থপরতার প্রতীক।** তিনি নির্দয়, শোষক এবং গ্রামের সর্বনাশ করেও নিজের সামান্য স্বার্থ দেখতে অভ্যস্ত। তাঁর মুখে শ্লেষ ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায়। |
| **রমেশ** | **মানবিকতার প্রতীক।** সে সহানুভূতিশীল, নির্ভীক, আদর্শবাদী এবং সমাজ সংস্কারক। সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে ও কাজ করতে দ্বিধা করে না। |
| **রমা** | **দ্বান্দ্বিক চরিত্রের প্রতীক।** শুরুতে সে আর্থিক হিসাবে আচ্ছন্ন, কিন্তু শেষে রমেশের অপমান ও সাহসিকতা দেখে তার সুকুমার মনস্তত্ত্ব জেগে ওঠে এবং সে মানসিক মুক্তি লাভ করে। |
আমার পছন্দের চরিত্র: আমার কাছে **রমেশ** চরিত্রটি সবথেকে ভালো লেগেছে। কারণ, সে কেবল মুখে মানবিকতার কথা বলেনি, বরং নিজের ক্ষতি স্বীকার করে এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই আদর্শকে কাজে পরিণত করেছে। যে সমাজে অধিকাংশ মানুষ স্বার্থপরতায় ডুবে থাকে, সেখানে রমেশের মতো একজন যুবক **দয়ার উপর জুলুম** সহ্য না করে, প্রবল প্রতিপক্ষ বেণীবাবুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তার এই **দৃঢ় সংকল্প ও মানবিক তেজ** তাকে সমাজের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরে।
১০. পল্লীসমাজ পাঠ্যাংশে সমান্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার কোন্ কোন্ নিদর্শন পেয়ে থাকলে সে সম্পর্কে আলোচনা করো। এ ধরনের ব্যবস্থার সুফল ও কুফল সম্পর্কে আলোচনা করো।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার নিদর্শন: আলোচ্য অংশে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সুস্পষ্ট নিদর্শন মেলে।
- **জমিদারের সর্বেসর্বা ক্ষমতা:** বেণীবাবু কেবল তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার জন্য হাজার হাজার কৃষকের অন্ন মারতে চেয়েছেন। তাঁর ধারণা ছিল, কৃষকদের জীবন তাঁর মর্জির ওপর নির্ভর করে (‘নইলে আর ব্যাটাদের ছোটোলোক বলেচে কেন?’)।
- **লাঠিয়ালের ব্যবহার:** জমিদারদের অনুগত লাঠিয়াল (যেমন আকবর আলি) ছিল, যাদের দিয়ে তারা সাধারণ প্রজাদের ওপর অত্যাচার করত।
- **কৃষকের অসহায়তা:** কৃষকেরা নিজেদের ধান বাঁচাতে জমিদারদের কাছে ‘কাঁদিয়া পড়িল’ ও ‘হত্যা দিয়া পড়িয়া’ ছিল, যা তাদের অসহায় অবস্থা নির্দেশ করে।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল ও কুফল:
| সুফল (Pros) | কুফল (Cons) |
|---|---|
| অতীতে জমিদাররা অনেক সময় গ্রামীণ সংস্কৃতি, মন্দির নির্মাণ ও শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করতেন। | কৃষকদের উপর শোষণ, লাগামহীন রাজস্ব আদায় এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা দেখা যেত (যেমন বেণীবাবুর আচরণ)। |
| সংকটের সময় গ্রামের মানুষ এক কাঠামোবদ্ধ সাহায্যের জন্য জমিদারদের ওপর নির্ভর করত। | সাধারণ মানুষের মানবিক অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব হতো। |