বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
চতুর্থ পাঠ: দাঁড়াও (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো | **বিষয়বস্তু:** মানব সংহতি, নিঃসঙ্গতা ও সহমর্মিতা।
—১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Philosophy)
শক্তি চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দাঁড়াও’ কবিতাটি আধুনিক জীবনের **নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণাবোধ এবং মানব সংহতির প্রয়োজনীয়তা**কে তুলে ধরে। কবি জানেন যে মানুষই মানুষের জন্য ‘ফাঁদ পাতছে’, তবুও মানুষের সকল দুঃখ-কষ্টের একমাত্র নিরাময় হলো অন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
মূল বক্তব্য:
- **যন্ত্রণার স্বীকৃতি:** কবি ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ এবং ‘মানুষ বড়ো একলা’। এই কান্নার কারণ কেবল প্রাকৃতিক নয়, বরং **মানুষের দ্বারাই সৃষ্ট**।
- **সহানুভূতিশীল আহ্বান:** কবি এই নিঃসঙ্গ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সহমর্মী মানুষের কাছে বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বান দিনের **সকাল থেকে রাত** পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে বিস্তৃত।
- **দাঁড়ানোর কৌশল:** পাশে দাঁড়ানোর পদ্ধতি কেমন হবে, কবি তাও নির্দিষ্ট করেছেন—তা হবে **পাখির মতো** (নম্র, ভয়হীন, শর্তহীন) এবং **ভালোবেসে**। এই দাঁড়ানো কেবল দৈহিক নয়, এটি এক **মানসিক ও আত্মিক উপস্থিতি**।
- **ত্রিপদী মন্ত্র:** কবিতায় ‘এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও’—এই তিন প্রকার দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে, যা মানুষের প্রতি **গভীরতম প্রেম ও দায়বদ্ধতা**কে প্রতিষ্ঠা করে।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **ফাঁদ:** এখানে ছলনা, ক্ষতি বা বিশ্বাসঘাতকতা অর্থে ব্যবহৃত।
- **একলা:** নিঃসঙ্গ, একা।
- **পাখির মতো:** কোনো শর্ত ছাড়া, মুক্ত মনে এবং অত্যন্ত নম্রভাবে।
- **তাহার:** সাধু ভাষার শব্দ, যার অর্থ ‘তার’ বা সেই ব্যক্তির।
- **ভেসে দাঁড়াও:** সব বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এসে বা দূর থেকেও মানসিক সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়ানো।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. ‘মতো’ শব্দ ব্যবহার করা হয় কখন? তোমার যুক্তির পক্ষে দুটি উদাহরণ দাও।
ব্যবহার: ‘মতো’ শব্দটি সাধারণত দুটি ভিন্ন বস্তুর মধ্যে **তুলনা বা সাদৃশ্য** বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
- আকাশের চাঁদটি যেন থালার **মতো** গোল।
- সে ছেলেটি যেন বাঘের **মতো** সাহসী।
২. কবি পাখির মতো পাশে দাঁড়াতে বলছেন কেন?
কবি জানেন, মানুষই মানুষের জন্য ‘ফাঁদ পাতছে’। তাই তিনি অন্য মানুষকে **পাখির মতো** পাশে দাঁড়াতে বলেছেন। পাখি যেমন মুক্ত, সরল, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বা কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়াই উড়ে আসে, তেমনি মানুষও যেন **শর্তহীন ভালোবাসা ও নম্রতা** নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
৩. ‘মানুষই ফাঁদ পাতছে’ কবি এ কথা কেন বলেছেন? ‘মানুষ’ শব্দের সঙ্গে ‘ই’ ধ্বনি যোগ করেছেন কেন- তোমার কী মনে হয়?
ব্যাখ্যা: কবি এ কথা বলেছেন কারণ মানুষ সমাজে **হিংসা, লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতার** দ্বারা একে অপরের ক্ষতি করছে। মানুষই যখন মানুষের শত্রু, তখন এই ফাঁদ পাতার কাজটি অত্যন্ত বেদনার্ত।
‘ই’ ধ্বনি যোগের কারণ: ‘মানুষ’ শব্দের সঙ্গে ‘ই’ ধ্বনি (নিশ্চয়তাজ্ঞাপক অব্যয়) যোগ করে কবি এই সত্যটিকেই **জোর দিয়ে** প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, এই ধ্বংস ও যন্ত্রণার জন্য অন্য কেউ নয়, একমাত্র **মানুষই দায়ী**।
৪. ‘তোমার মতো মনে পড়ছে’- এই পঙ্ক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ কী?
এই পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে কবি মানুষের প্রতি তাঁর **অবিরাম দায়িত্ব ও সংহতিবোধকে** বোঝাতে চেয়েছেন। ‘তোমার মতো’ বলতে সেই **অসহায়, নিঃসঙ্গ ও যন্ত্রণাকাতর মানুষটির** কথা বলা হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে সেই মানুষের কষ্টকে কবি নিজের মনে অনুভব করছেন, অর্থাৎ এই **সহানুভূতি কখনও শেষ হয় না**।
৫. ‘এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও’- এই পঙ্ক্তিটির বিশেষত্ব কোথায়? এই ধরনের দুটি বাক্য তুমি তৈরি করো।
বিশেষত্ব: এই পঙ্ক্তিটিতে কবি একটি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর **তিনটি স্তর বা প্রক্রিয়া** নির্দেশ করেছেন—১. **এসে দাঁড়াও** (শারীরিক উপস্থিতি), ২. **ভেসে দাঁড়াও** (বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়ে আসা বা মানসিক সমর্থন), এবং ৩. **ভালোবেসে দাঁড়াও** (শর্তহীন মানবিক আবেগ)। এটি মানব সংহতির একটি **ত্রিপদী মন্ত্র**।
নমুনা বাক্য:
- চলো চলো বলো বলো এবং কাজ করো চটপট।
- লেখো লেখো আঁকো আঁকো এবং দেখাও তোমার সৃজন।
বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৩-৫ নম্বর):
৬. ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ কী কারণে কবি এই কথা বলেছেন?
‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ – কবির এই উক্তি আধুনিক মানুষের গভীর যন্ত্রণাবোধকে নির্দেশ করে। এই কান্নার মূল কারণগুলি হলো:
- **নিঃসঙ্গতা:** বর্তমান জটিল জীবনে মানুষ তার নিজস্ব পরিবেশে থেকেও একা বা ‘একলা’ হয়ে পড়েছে। এই নিঃসঙ্গতা এক গভীর কান্নার জন্ম দিয়েছে।
- **বিশ্বাসঘাতকতা:** কবি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে মানুষই মানুষের জন্য ‘ফাঁদ পাতছে’। অর্থাৎ, সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেছে এবং মানুষ একে অপরের ক্ষতি করছে, যা কান্নার এক প্রধান কারণ।
- **অসহায়তা:** নিঃসঙ্গতা ও বিশ্বাসঘাতকতার এই চক্রে পড়ে মানুষ তার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। দুঃখ, হতাশা, বঞ্চনা ও সামাজিক অত্যাচারের মুখে মানুষ নিজেকে অসহায় মনে করে, যার বহিঃপ্রকাশ হলো এই কান্না।
৭. ‘মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’- এই পঙ্ক্তিটিকে তিনবার ব্যবহার করার কারণ কী হতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
কবিতায় ‘মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’—এই পঙ্ক্তিটি তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। এর প্রধান কারণগুলি হলো:
- **গুরুত্ব আরোপ (Emphasis):** এই পঙ্ক্তিটি কবিতার **মূল বক্তব্য** বা কেন্দ্রবিন্দু। এটিকে বারবার ব্যবহার করে কবি নিঃসঙ্গ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে পাঠকের মনে বারবার জাগাতে চেয়েছেন।
- **আহ্বানের তীব্রতা:** এটি কেবল একটি অনুরোধ নয়, বরং **জরুরি অবস্থার আহ্বান**। যন্ত্রণাকাতর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যে দায়বদ্ধতা দরকার, তার প্রতি কবি বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
- **ছন্দ ও সুর:** কবিতার শুরুতে, মাঝে এবং শেষে পঙ্ক্তিটির ব্যবহার কবিতাটিকে একটি বিশেষ **গীতলতা ও আবৃত্তির সুর** দিয়েছে, যা কবিতার মূল ভাবটিকে আরও বেশি সংহত ও মর্মস্পর্শী করে তোলে।
৮. ‘দাঁড়াও’ কবিতার মূল বক্তব্য কী? মানব সংহতি রক্ষায় কবি কীভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, আলোচনা করো।
মূল বক্তব্য: ‘দাঁড়াও’ কবিতার মূল বক্তব্য হলো **ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ও সামগ্রিক মানব সংহতির প্রয়োজনীয়তা**। কবি আধুনিক সমাজে মানুষের যন্ত্রণাবোধ (‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’) এবং তার অসহনীয় একাকীত্বকে (‘মানুষ বড়ো একলা’) চিহ্নিত করেছেন। কবি এই চরম সংকটের মোকাবিলায় অন্য মানুষের এগিয়ে আসার মন্ত্রণা দিয়েছেন।
আহ্বান ও কৌশল: মানব সংহতি রক্ষায় কবি বিশেষ কয়েকটি উপায়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন:
- **মানুষের ভূমিকা:** কবি প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে একজন মানুষ হিসেবেই অন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য (‘তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’)।
- **শর্তহীন সমর্পণ:** পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াটি হতে হবে সম্পূর্ণ শর্তহীন, **পাখির মতো** সরল ও মুক্ত। এমনকি, যদি জানা থাকে যে মানুষই ‘ফাঁদ পাতছে’, তবুও তার পাশে থাকতে হবে।
- **ত্রিমাত্রিক উপস্থিতি:** কবি ‘এসে দাঁড়াও’, ‘ভেসে দাঁড়াও’ এবং ‘ভালোবেসে দাঁড়াও’—এই তিনটি স্তরের মাধ্যমে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।
- **এসে দাঁড়ানো** দৈহিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে।
- **ভেসে দাঁড়ানো** জীবনের বাধা পেরিয়েও এগিয়ে আসার সাহসকে বোঝায়।
- **ভালোবেসে দাঁড়ানো** হলো নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক মানবিক সমর্থন।
- **চিরন্তন অঙ্গীকার:** সকাল, সন্ধ্যা, রাত—প্রতিটি সময়েই এই যন্ত্রণাকাতর মানুষটিকে মনে পড়ছে। অর্থাৎ, এই সংহতি কোনো সাময়িক প্রচেষ্টা নয়, বরং তা জীবনের এক **অবিচ্ছিন্ন অঙ্গীকার** হওয়া চাই।
এইভাবে কবি মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মাধ্যমেই সমস্ত অন্ধকার জয় করার কথা বলেছেন।