বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
তৃতীয় পাঠ: পরবাসী (বিষ্ণু দে) – নোটস ও উত্তর
**বিষয়বস্তু:** প্রকৃতির ধ্বংস, শহুরে বিচ্ছিন্নতা, এবং একটি আদর্শ বাসভূমির খোঁজ।
—১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Philosophy)
বিষ্ণু দে রচিত ‘পরবাসী’ কবিতাটি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। এই কবিতাটির প্রথম তিন স্তবকে কবি প্রকৃতির মনোরম ও প্রাণবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন, যেখানে পশুপাখি, পথ ও বনের মধ্যে এক ছন্দময় জীবন লক্ষ করা যায়। কিন্তু শেষ দুই স্তবকে সেই চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টে যায়।
মূল বক্তব্য:
- **প্রকৃতির জয়গান:** প্রথম অংশে খরগোশ, বনময়ূর, চিতা, সিন্ধুমুনির হরিণ-আহ্বান ইত্যাদির মাধ্যমে এক পূর্ণাঙ্গ বন্য প্রাণের ছবি আঁকা হয়েছে। এই জগৎ ছিল **সুষমাময়**।
- **প্রকৃতির বিপর্যয়:** পরবর্তী অংশে সেই বন ‘সাফ’, গ্রাম ‘মরে গেছে’, এবং ময়ূর ‘পণ্যে’ পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, মানুষের লোভ ও নগরায়ণের ফলে প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে।
- **মৌন অসহায়তা:** এই ধ্বংসলীলার কারণে মানুষ নিজে মৌন ও অসহায় হয়ে পড়েছে। নদী, গাছ, পাহাড় মানুষের কাছে মূল্যহীন হয়ে উঠেছে।
- **পরবাসীর আত্মজিজ্ঞাসা:** কবি নিজেকে ‘পরবাসী’ হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি নিজের আদর্শ বাসভূমি বা স্বভূমি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁবু বয়ে আর কতদিন ঘুরতে হবে? কবি কবে তাঁর নিজবাসভূমি গড়বেন?
কবিতাটির মূল ভাব হলো, প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের সম্পর্ক নষ্ট হলে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিজেকে পরবাসী মনে করে, যদিও সে নিজের দেশেই থাকে।
—২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দার্থ
- **নিটোল:** সুগোল, সম্পূর্ণ।
- **পুলক:** আনন্দ, খুশি।
- **কথক:** উত্তর ভারত ও রাজস্থানের এক ধরনের ধ্রুপদি ঘরানার নৃত্যশৈলী বা নৃত্যশিল্পী।
- **সুষমা:** শোভা, সৌন্দর্য।
- **লুব্ধ:** লোলুপ, লোভী।
- **কথাকলি:** কেরলের এক প্রকার ধ্রুপদি নৃত্যশৈলী।
- **পত্তন:** স্থাপন, প্রতিষ্ঠা।
- **পণ্যে:** বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী হিসেবে।
- **গৌণ:** অপ্রধান, মূল্যহীন।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. পথ কীসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে?
পথ **প্রকৃতির তালে তালে** এঁকে বেঁকে চলে।
২. চিতার চলে যাওয়ার ছন্দটি কেমন?
চিতার চলে যাওয়ার ছন্দটি ছিল **লুব্ধ হিংস্র ছন্দে**, যা বন্য প্রাণের কথাকলি বেগ জাগিয়ে তোলে।
৩. ময়ূর কীভাবে মারা গেছে?
কবিতায় বলা হয়েছে, ময়ূর **পণ্যে** (অর্থাৎ, বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী, যেমন পালক বা মাংস) পরিণত হয়ে মারা গেছে।
৪. প্রান্তরে কার হাহাকার শোনা যাচ্ছে?
প্রান্তরে **শুকনো হাওয়ার** হাহাকার শোনা যাচ্ছে।
৫. পলাশের ঝোপে কবি কী দেখেছেন?
নিটোল টিলার পলাশের ঝোপে কবি হঠাৎ আনন্দে (পুলকে) **বনময়ূরের কথক** (নৃত্য) দেখেছেন।
৬. কথক ও কথাকলি-র কথা কবিতার মধ্যে কোন প্রসঙ্গে এসেছে?
বনময়ূরের নৃত্যভঙ্গিমা দেখে কবি সেটিকে **’কথক’** নৃত্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার, চিতার লুব্ধ হিংস্র ছন্দে চলে যাওয়ার বন্য বেগ-কে কবি **’কথাকলি’** নৃত্যের বেগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এভাবে প্রকৃতির ছন্দময়তাকে বোঝানোর জন্য এই দুটি নৃত্যের প্রসঙ্গ এসেছে।
৭. সেতারের বিশেষণ হিসেবে কবি ‘সোনালি’ শব্দের ব্যবহার করেছেন কেন?
নদীর জল বা তটে যখন সূর্যের সোনালি আলো পড়ে, তখন নদীর কিনারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কবি সেই আলো ঝলমলে দৃশ্যকে সঙ্গীতের **সুষমা বা সৌন্দর্যের প্রতীক** সেতারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নদীর জল বা বালুকার **সোনালি রঙের আভা** এবং সেতারের ঝঙ্কার—এই দুইয়ে মিলে এক সুন্দর দৃশ্য-শ্রাব্য চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে, তাই ‘সোনালি’ বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৮. ‘সিন্ধুমুনির হরিণ-আহ্বান’ কবি কীভাবে শুনেছেন?
কবি যখন নদীর কিনারে পশুপাখিদের জলপান করতে দেখছিলেন, তখন তিনি সেই **বনের নিস্তব্ধতা ও পবিত্রতার** মধ্যে সিন্ধুমুনির হরিণ-আহ্বানের সুরটি শুনতে পেয়েছেন। এটি সিন্ধুমুনির মতো নির্জনতাপ্রিয় মানুষের প্রতি কবির শ্রদ্ধাকে ইঙ্গিত করে।
৯. ‘জঙ্গল সাফ, গ্রাম মরে গেছে, শহরের/পত্তন নেই…’- প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই পঙ্ক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করো।
এই পঙ্ক্তিগুলি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মর্মান্তিক পতনের ইঙ্গিত দেয়।
- প্রাসঙ্গিকতা: কবি দেখাচ্ছেন, মানুষ যখন লোভী হয়ে ওঠে, তখন সে বসতি স্থাপনের জন্য নয়, বরং ব্যবসার জন্য **জঙ্গল সাফ** করে দেয়।
- বিপর্যয়: জঙ্গল ধ্বংস হওয়ায় গ্রাম (যা প্রকৃতির কোলে জন্ম নেয়) **’মরে গেছে’**, অথচ তার জায়গায় কোনো সুস্থ **শহরের পত্তন** (স্থাপন) হয়নি। এটি নির্দেশ করে যে, শুধু ধ্বংসই হয়েছে, কোনো গঠনমূলক কাজ হয়নি।
- ফলাফল: মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাই সে এখন শুধু **শুকনো হাওয়ার হাহাকার** শুনতে পায়।
১০. ‘ময়ূর মরেছে পণ্যে’ এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী?
এই পঙ্ক্তিটির অন্তর্নিহিত অর্থ গভীর এবং মর্মস্পর্শী।
- আক্ষরিক অর্থ: একসময় যে বনময়ূর পুলকে নৃত্য করত, এখন মানুষের লোভের কারণে তার পালক বা দেহ বিক্রির সামগ্রী বা **’পণ্যে’** পরিণত হয়েছে।
- তাৎপর্য: এটি প্রকৃতির **সৌন্দর্যের অপমৃত্যু** এবং মানব সমাজের **অন্ধ ভোগের লিপ্সা**কে তুলে ধরে। যেখানে সৌন্দর্য ছিল পূজনীয়, সেখানে তা এখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির মাপকাঠি। বনময়ূর এখানে সমগ্র **বন্য প্রাণ ও প্রকৃতির** প্রতীক, যার অপমৃত্যুর কারণ হলো মানুষের লোভ।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
১১. ‘পরবাসী’ কবিতার প্রথম তিনটি স্তবক ও শেষ দুটি স্তবকের মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের কোন্ পার্থক্য থাকলে তা নিজের ভাষায় লেখো।
‘পরবাসী’ কবিতার গঠনশৈলী এবং বক্তব্য বিষয় দুই স্তবকে বিভক্ত, যা এই দুই অংশের মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য (Contrast) সৃষ্টি করেছে।
প্রথম তিনটি স্তবকের বক্তব্য: (প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও ছন্দ)
- এই অংশে প্রকৃতি ছিল অত্যন্ত **প্রাণবন্ত ও মুখর**। ‘দুই দিকে বন, মাঝে ঝিকিমিকি পথ’ ছিল।
- এখানে খরগোশের লাফ, বনময়ূরের কথক নৃত্য, চিতার লুব্ধ ছন্দে চলে যাওয়া এবং নদীর কিনারে জলপান—এসবের মাধ্যমে **বন্য প্রাণের এক স্বাভাবিক ও ছন্দময়** ছবি ফুটে উঠেছে।
- কবির মন ছিল তখন প্রকৃতির সুষমার সঙ্গে মিলে যাওয়া এক **শান্ত ও আনন্দময়** অবস্থায় (‘তাঁবুর ছায়ায় নদীর সোনালি সেতারে / মিলিয়েছি তার সুষমা’)।
শেষ দুটি স্তবকের বক্তব্য: (ধ্বংস, শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতা)
- এই অংশ সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে **প্রকৃতির ধ্বংসলীলা** ফুটে উঠেছে। ‘জঙ্গল সাফ’, ‘গ্রাম মরে গেছে’, এবং ‘শহরের পত্তন নেই’।
- সৌন্দর্য ও প্রাণের প্রতীক ময়ূর এখন **’পণ্যে’** পরিণত। মানুষ মৌন ও অসহায়, নদী, গাছ, পাহাড় মানুষের কাছে **’গৌণ’**।
- প্রকৃতি ধ্বংস হওয়ায় কবি নিজেকে **’পরবাসী’** হিসেবে অনুভব করছেন এবং তাঁর মনে এক গভীর হাহাকার (‘শুকনো হাওয়ার হাহাকার’) জেগে উঠেছে।
পার্থক্য: প্রথম অংশে প্রকৃতি ছিল **স্বমহিমায় উজ্জ্বল ও সঙ্গীতময়**; আর শেষ অংশে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে **এক শূন্য, বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন পরিবেশ**। এই পরিবর্তন কবির মনে জন্ম দিয়েছে ‘নিজবাসভূমি’ গড়ার আকাঙ্ক্ষা।
১২. কবি নিজেকে ‘পরবাসী’ বলেছেন কেন? শেষ স্তবকের বিশিষ্টতা কোথায়? এর থেকে কবি-মানসিকতার কী পরিচয় পাওয়া যায়?
কবি কেন পরবাসী: কবি বিষ্ণু দে নিজেকে ‘পরবাসী’ বা প্রবাসী বলেছেন, যদিও তিনি তাঁর স্বভূমি বা দেশেই আছেন। এর কারণটি আক্ষরিক নয়, বরং দার্শনিক ও মানসিক।
- কবি যে **আদর্শ প্রকৃতি ও জীবনযাত্রা** ভালোবাসেন (প্রথম তিন স্তবকে বর্ণিত), তা মানব সমাজের লোভ ও ধ্বংসের কারণে আজ বিলুপ্ত।
- ‘জঙ্গল সাফ’, ‘গ্রাম মরে গেছে’ এবং ‘ময়ূর মরেছে পণ্যে’—এইসব দেখে কবি অনুভব করছেন, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নেই, সেখানে তিনি **মানসিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন ও নির্বাসিত**। তাই তিনি নিজের দেশেই ‘পরবাসী’।
শেষ স্তবকের বিশিষ্টতা ও কবি-মানসিকতা:
- শেষ স্তবকের বৈশিষ্ট্য হলো এটি কবিতার **মূল ভাব ও প্রশ্নচিহ্ন** বহন করে। প্রথম চার স্তবক হলো বর্ণনা, আর শেষ স্তবক হলো **আর্তনাদ ও জিজ্ঞাসা**।
- এই অংশে কবি প্রশ্ন তুলেছেন, “কেন নদী গাছ পাহাড় এমন গৌণ?” এবং “পরবাসী কবে নিজবাসভূমি গড়বে?”।
- এই প্রশ্নগুলির মাধ্যমে কবির **সমাজ-সচেতন, প্রকৃতিপ্রেমী ও আদর্শবাদী** পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি কেবল প্রকৃতির ধ্বংস দেখেই ক্ষান্ত হননি, বরং এই ধ্বংসের কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হওয়ার মাধ্যমে একটি **আদর্শ ‘নিজবাসভূমি’** গড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।
এইভাবেই ‘পরবাসী’ শব্দটি কেবল ঠিকানা নয়, কবির **বিপন্ন মনস্তত্ত্বের** প্রতীক হয়ে উঠেছে।