দ্বিতীয় পাঠ: অদ্ভুত আতিথেয়তা (নোট)
প্রসেসিং হচ্ছে…

বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)

দ্বিতীয় পাঠ: অদ্ভুত আতিথেয়তা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) – নোটস ও উত্তর

**উৎস:** আখ্যানমঞ্জরী | **বিষয়বস্তু:** আরব জাতির আতিথেয়তা ধর্ম এবং ব্যক্তিগত বৈরসাধন সংকল্পের দ্বন্দ্ব।

— ### ১. গল্প পরিচিতি ও সারমর্ম (Summary)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত এই গল্পটি আরব ও মুর জাতির মধ্যে চলমান সংঘাতের ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা। এই গল্পের মূল আকর্ষণ হলো **আরব সেনাপতির মহান আতিথেয়তা ধর্ম** এবং তাঁর **পিতৃহত্যার প্রতিশোধ** নেওয়ার সংকল্পের মধ্যে সৃষ্ট তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব।

মূল ঘটনা:

  • আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক **মুর সেনাপতি** প্রাণভয়ে পালিয়ে আসার সময় পথ ভুলে আরব শিবিরে আশ্রয় চান।
  • **আরব সেনাপতি** জাতিগত আতিথেয়তা ধর্মের কারণে মুর সেনাপতিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
  • কথোপকথনের সময় মুর সেনাপতির কথা শুনে আরব সেনাপতি জানতে পারেন যে, এই ব্যক্তিই তাঁর **পিতার হত্যাকারী**।
  • আরব সেনাপতির মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলেও তিনি জাতীয় ধর্ম রক্ষায় অটল থাকেন। তিনি **অতিথিকে হত্যা না করে** দ্রুত প্রস্থান করার জন্য একটি তেজস্বী অশ্ব ও পথখরচা প্রদান করেন।
  • সূর্যোদয়ের পর অতিথি চলে গেলে, তিনি নিজেও সেই ঘোড়ায় চেপে **শত্রু হিসেবে** মুর সেনাপতির পিছু নেন, কিন্তু মুর সেনাপতি নির্বিঘ্নে নিজের শিবিরে পৌঁছলে আরব সেনাপতি আর অনুসরণ করেন না।

এই ঘটনায় আরব সেনাপতি মুহূর্তের জন্য ব্যক্তিগত ক্রোধ ও জাতীয় আতিথেয়তা—দুই মহৎ আদর্শের সংঘাতে পড়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আতিথেয়তা ধর্মকেই জয়ী করেন, তাই এটি ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’।

— ### ২. চরিত্র বিশ্লেষণ
  • **মুর সেনাপতি:** যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত, ভীত ও ক্লান্ত হলেও তাঁর মধ্যে **সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধ** ছিল। তিনি নিজের ও পূর্বপুরুষদের পরাক্রমের কথা নির্ভীকভাবে বলতে দ্বিধা করেননি।
  • **আরব সেনাপতি:** গল্পের প্রধান চরিত্র। তাঁর চরিত্রে **জাতীয় আতিথেয়তা ধর্মের প্রতি গভীর নিষ্ঠা** এবং **পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের সংকল্প**—এই দুটি গুণের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। তিনি ধর্ম রক্ষায় ব্যক্তিগত প্রতিশোধের বাসনাকে বর্জন করে এক মহৎ আদর্শ স্থাপন করেছেন।
— ### ৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)

(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):

১. ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পে কোন্ কোন্ সেনাপতির প্রসঙ্গ রয়েছে? [১ নম্বর]

গল্পে **আরব সেনাপতি** এবং **মুর সেনাপতির** প্রসঙ্গ রয়েছে।

২. ‘তিনি, এক আরবসেনাপতির পটমণ্ডপদ্বারে উপস্থিত হইয়া, আশ্রয় প্রার্থনা করিলেন।’ উদ্ধৃতাংশে ‘তিনি’ বলতে কার কথা বোঝানো হয়েছে? [১ নম্বর]

উদ্ধৃতাংশে ‘তিনি’ বলতে **মুর সেনাপতিকে** বোঝানো হয়েছে, যিনি আরব জাতির সঙ্গে সংঘর্ষের পর প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় চেয়েছিলেন।

৩. ‘উভয় সেনাপতির কথোপকথন হইতে লাগিল।’- ‘উভয় সেনাপতি’ বলতে এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে? [১ নম্বর]

‘উভয় সেনাপতি’ বলতে এখানে **আশ্রয়দাতা আরব সেনাপতি** এবং **আশ্রয়প্রার্থী মুর সেনাপতিকে** বোঝানো হয়েছে।

৪. ‘তাহা হইলে আমাদের উভয়ের প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা।’ প্রাণরক্ষার কোন্ উপায় বক্তা এক্ষেত্রে বলেছেন? [২ নম্বর]

বক্তা (আরব সেনাপতি) বলেছেন যে, মুর সেনাপতিকে তিনি যে দ্রুতগামী অশ্বটি দিচ্ছেন, যদি সেটি তাঁর অশ্ব অপেক্ষা দ্রুতবেগে গমন করতে পারে, তবেই দুজনের প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা থাকবে। এটি মূলত **মুর সেনাপতির প্রাণরক্ষার উপায়**।

৫. ‘আপনি সত্বর প্রস্থান করুন।’ বক্তা কেন উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে ‘সত্বর প্রস্থান’ করার নির্দেশ দিলেন? [২ নম্বর]

বক্তা (আরব সেনাপতি) জানেন যে আশ্রয়প্রার্থী মুর সেনাপতিই তাঁর **পিতার হত্যাকারী**। কিন্তু জাতীয় ধর্ম অনুযায়ী সূর্যোদয়ের আগে অতিথিকে আঘাত করা যায় না। তাই তিনি সূর্যোদয়ের পূর্বে অতিথিকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে ‘সত্বর প্রস্থান’ করার নির্দেশ দেন।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):

৬. ‘তাঁহার দিভ্রম জন্মিয়াছিল।’- এখানে কার কথা বলা হয়েছে? দিভ্রম হওয়ার পরিণতি কী হলো? [৩ নম্বর]

এখানে **মুর সেনাপতির** কথা বলা হয়েছে।
**দিভ্রম হওয়ার পরিণতি:** মুর সেনাপতির দিভ্রম হওয়ায় তিনি দিকনির্ণয় করতে পারেননি। ফলে, তিনি স্বপক্ষীয় শিবিরের পরিবর্তে বিপক্ষ **আরবসেনাপতির শিবিরসন্নিবেশস্থানে** উপস্থিত হন এবং সেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বাধ্য হন।

৭. ‘আতিথেয়তা বিষয়ে পৃথিবীতে কোনও জাতিই আরবদিগের তুল্য নহে।’ এই বক্তব্যের সমর্থন গল্পে কীভাবে খুঁজে পেলে? [৩ নম্বর]

আরব জাতির আতিথেয়তা তুলনাহীন, তার প্রমাণ গল্পে সুস্পষ্ট। আরব সেনাপতি একজন **শত্রু সেনাপতিকে** নিজের পটমণ্ডপের দ্বারে আশ্রয় চাইতে দেখেও বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ প্রদর্শন করেননি। উল্টে তিনি মুর সেনাপতিকে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত দেখে **আহারাদির উদ্যোগ** করেন, তাঁকে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেন এবং বন্ধুভাবে কথোপকথন শুরু করেন। এমনকি সত্য জানতে পারার পরেও তিনি অতিথির কোনো অনিষ্ট চিন্তা করেননি। এই আচরণই আরব জাতির আতিথেয়তা ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।

৮. ‘সহসা আরবসেনাপতির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল।’ আরবসেনাপতির মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে ওঠার কারণ কী? [৩ নম্বর]

আরব সেনাপতি ও মুর সেনাপতির মধ্যে যখন স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদের সাহস-পরাক্রম নিয়ে কথোপকথন চলছিল, তখন মুর সেনাপতি নিজের পূর্বপুরুষের বৃত্তান্ত বর্ণনার সময় আরব সেনাপতির **পিতার প্রাণহন্তার নির্দেশ** করেছিলেন। আরব সেনাপতি শ্রবণমাত্রই বুঝতে পারেন যে তাঁর সামনে উপস্থিত অতিথিই তাঁর **পিতৃহন্তা শত্রু**। পিতৃহত্যার প্রতিশোধের বাসনা মনে তীব্র আঘাত দেওয়ায় তাঁর মুখ হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল।

৯. ‘সন্দিহানচিত্তে শয়ন করিলেন।’ এখানে কার মনের সন্দেহের কথা বলে হয়েছে? তাঁর মনের এই সন্দেহের কারণ কী? [৩ নম্বর]

এখানে **মুর সেনাপতির** মনের সন্দেহের কথা বলা হয়েছে।
**সন্দেহের কারণ:** আতিথেয়তা চলাকালীন হঠাৎ আরব সেনাপতির মুখ বিবর্ণ হয়ে যাওয়া এবং অসুস্থতার অজুহাতে মাঝপথে গাত্রোত্থান করে চলে যাওয়া, পরক্ষণেই লোক মারফত আহার ও শয্যার বন্দোবস্তের খবর পাঠানো, সর্বোপরি অতি প্রত্যুষে দ্রুতগামী অশ্ব প্রস্তুত রাখার প্রতিশ্রুতি—এইসব অস্বাভাবিক আচরণ ও বার্তার মর্ম বুঝতে না পেরে মুর সেনাপতি সন্দিহানচিত্তে শয়ন করেছিলেন।

রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):

১০. গল্পের ঘটনা বিশ্লেষণ করে মন্তব্যটির যথার্থতা প্রতিপন্ন করো: ‘আতিথেয়তা বিষয়ে পৃথিবীর কোনও জাতিই আরবদিগের তুল্য নহে।’ [৫ নম্বর]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পে আরব জাতির আতিথেয়তা ধর্মকে এক মহৎ আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। গল্পে বর্ণিত নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি মন্তব্যটির যথার্থতা প্রমাণ করে:

  1. শত্রুকে আশ্রয় দান: আরব সেনাপতি যখন জানতে পারেন যে আশ্রয়প্রার্থী মুর সেনাপতি তাদের বিপক্ষ দলের, তখনো তিনি জাতীয় ধর্ম অনুসারে তাঁর পরিচর্যা করেন।
  2. ধর্ম রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত ক্রোধ দমন: কথোপকথনের মাধ্যমে যখন তিনি নিশ্চিত হন যে অতিথিই তাঁর পিতৃহন্তা, তখনো তিনি প্রতিশোধের বাসনাকে দমন করেন।
  3. সতর্কতা ও সাহায্য: তিনি মুর সেনাপতির বিশ্রাম ও আহারের সুব্যবস্থা করে দেন এবং পরদিন ভোরে তাঁকে দ্রুত পালানোর জন্য **নিজের তেজস্বী অশ্বটি** প্রদান করেন।
  4. সত্য স্বীকার: তিনি মুর সেনাপতিকে বিদায় দেওয়ার আগে স্পষ্টতই জানিয়ে দেন যে সূর্যোদয়ের পর অতিথিভাব অপগত হলে তিনি শত্রু হিসেবে তাঁর অনুসরণ করবেন। এই **উদার সতর্কতা** আতিথেয়তা ধর্মের চূড়ান্ত নিদর্শন।

আরব সেনাপতি মুহূর্তের জন্য অতিথিকে হত্যা করার শপথ নিলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি **প্রাণান্ত ও সর্বস্বান্ত** হলেও অতিথির অনিষ্টচিন্তা না করার জাতীয় ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ স্থান দেন। এই অসাধারণ মানসিকতা প্রমাণ করে যে আতিথেয়তার ক্ষেত্রে আরব জাতির তুলনা সত্যিই বিরল।

১১. আরব সেনাপতির চরিত্রে জাতীয় ধর্ম ও ব্যক্তিগত সংকল্পের যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়, তা আলোচনা করো। এই দ্বন্দ্বে কোনটির জয় হলো? [৫ নম্বর]

গল্পে আরব সেনাপতির চরিত্রে এক তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। দুটি বিপরীত আদর্শের মধ্যে ছিল এই সংঘাত:

  1. জাতীয় ধর্ম (আতিথেয়তা): আরবদের জাতীয় ধর্ম হলো অতিথির সম্মান রক্ষা করা এবং তার কোনো ক্ষতি না করা। তাদের বিশ্বাস, শত্রু হলেও অতিথি এলে তার পরিচর্যা করাই বিধেয়।
  2. ব্যক্তিগত সংকল্প (বৈরসাধন): আরব সেনাপতি জানতে পারেন যে তাঁর অতিথিই তাঁর **পিতৃহন্তা শত্রু**। তাই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে সূর্যোদয়ের পর পিতৃহন্তার প্রাণবধ করবেন।

দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ: পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া তাঁর ব্যক্তিগত কর্তব্য, কিন্তু অতিথিকে রক্ষা করা তাঁর জাতীয় ধর্ম। এই দুই মহৎ গুণের সংঘাতই তাঁর মুখ বিবর্ণ করে তুলেছিল। তিনি যদি প্রতিশোধ নিতেন, তবে জাতীয় ধর্ম ভঙ্গ হতো; আর যদি অতিথিকে ছেড়ে দিতেন, তবে ব্যক্তিগত সংকল্প অপূর্ণ থাকত।

জয়ের পরিচয়: এই দ্বন্দ্বে **জাতীয় ধর্মের** জয় হলো। আরব সেনাপতি প্রতিশোধের বাসনা সাময়িকভাবে বর্জন করে অতিথির প্রাণ রক্ষায় মনোযোগ দেন। তিনি মুর সেনাপতিকে শুধু পালানোর সুযোগই দেননি, বরং তার জন্য দ্রুতগামী অশ্বও প্রস্তুত করে দেন। এই ত্যাগের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করলেন যে, আরব জাতির কাছে আতিথেয়তা ধর্মই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu