বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
ষষ্ঠ পাঠ: নাটোরের কথা (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** আত্মকথা ও স্মৃতিচারণামূলক রচনা | **বিষয়বস্তু:** নাটোর রাজ্যের রাজার আমন্ত্রণ এবং সেই সভার মাধ্যমে বিভিন্ন সাহিত্যিক ও গুণীজনের মিলন ও আলাপ-আলোচনার স্মৃতি।
—১. রচনা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের **’নাটোরের কথা’** একটি স্মৃতিচারণামূলক রচনা। এটি দিঘাপতিয়ার রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের আমন্ত্রণে নাটোর স্টেটে অনুষ্ঠিত একটি সাহিত্য সভার অভিজ্ঞতার বিবরণ। এই সভায় যোগ দিতে লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের সঙ্গে ট্রেনে করে নাটোরে যান।
মূল বক্তব্য:
- **ভ্রমণের অভিজ্ঞতা:** লেখক কলকাতার স্টেশন থেকে ট্রেনে করে নাটোরে যাত্রা শুরু করেন। ট্রেনে তার সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। এই যাত্রা ছিল সাহিত্যিকদের এক আনন্দময় মিলন।
- **নাটোরের সভা:** নাটোরের রাজা সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। তিনি সাহিত্যিকদের জন্য একটি বড়ো সভার আয়োজন করেছিলেন। সেই সভায় বিভিন্ন সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
- **আলোচনা ও আতিথেয়তা:** লেখক এই সভায় যোগ দিয়ে বিভিন্ন গুণীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ পান। রাজার আতিথেয়তা ছিল রাজকীয় ও আন্তরিক।
- **অবনীন্দ্রনাথের ভূমিকা:** লেখক, অবনীন্দ্রনাথ, সেখানে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সভার ছবি আঁকেন। তিনি সেই পরিবেশে নিজেকে **’ছবিওয়ালা’** হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।
- **রবীন্দ্রনাথের প্রভাব:** এই সভায় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গান ও আলোচনা সভায় এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল।
- **স্মৃতিচারণার গুরুত্ব:** এই রচনাটি সেই সময়ের **বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্য-সমাজের** একটি জীবন্ত ছবি তুলে ধরে, যেখানে সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **দিঘাপতিয়া:** নাটোর রাজ্যের রাজাদের উপাধি বা একটি অঞ্চলের নাম।
- **জসীমউদ্দীন:** গ্রাম বাংলার কবি (কবিতা ষষ্ঠ পাঠের পরের অংশে রয়েছে)।
- **সিন্দুক:** মূল্যবান জিনিস রাখার জন্য ব্যবহৃত বড়ো পেটি বা বাক্স।
- **নজর:** দৃষ্টি, মনোযোগ বা দেখভাল।
- **আতিথেয়তা:** অতিথির সেবা-যত্ন।
- **গদাইলস্করি চাল:** বিশাল, মন্থর বা আলসে চাল, ধীরে ধীরে কোনো কাজ করা।
- **চিত্রকর:** যিনি ছবি আঁকেন।
- **অটোগ্রাফ:** স্বাক্ষর বা স্বহস্তে লেখা কোনো কথা।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. ‘নাটোরের কথা’ রচনাটির রচয়িতা কে?
‘নাটোরের কথা’ রচনাটির রচয়িতা হলেন **অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর**।
২. লেখক কার আমন্ত্রণে নাটোরে গিয়েছিলেন?
লেখক নাটোরের দিঘাপতিয়া **রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের** আমন্ত্রণে নাটোরে গিয়েছিলেন।
৩. লেখকের সহযাত্রী কারা ছিলেন?
লেখকের সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন **রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার** এবং আরও অনেকে।
৪. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে কী নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে **’ছবিওয়ালা’** নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৫. ‘গদাইলস্করি চালে’ – এই শব্দটির অর্থ কী? এই প্রসঙ্গে লেখক কী বলতে চেয়েছেন?
‘গদাইলস্করি চাল’ শব্দের অর্থ হলো **মন্থর বা আলসে গতি**। এটি একটি উপমা, যার দ্বারা খুব ধীরে কাজ করা বা আলসেমি করা বোঝানো হয়।
প্রসঙ্গ: লেখক নাটোর যাত্রার সময় সেই পুরোনো আমলের ট্রেনের **ধীর গতি** বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেন ট্রেনটি কোনো কাজের ব্যস্ততা ছাড়াই খুব আলসেভাবে চলেছে। এই গতির কারণেই তাদের যাত্রা অনেক দীর্ঘ হয়েছিল।
৬. ‘আমরা তো সেই ছবিওয়ালা।’ – বক্তা কে? কোন প্রসঙ্গে তিনি এই উক্তিটি করেছেন?
বক্তা: উক্তিটির বক্তা হলেন লেখক নিজেই, **অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর**।
প্রসঙ্গ: নাটোরের সভায় যখন অন্যান্য সাহিত্যিক বা পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাঁদের **গুণ ও পাণ্ডিত্যের** পরিচয় দিচ্ছিলেন, তখন অবনীন্দ্রনাথ নিজের পরিচয়টিকে **সরল ও বিনয়ীভাবে** তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি নিজেকে একজন **চিত্রকর** হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন যে তিনি কোনো গম্ভীর পণ্ডিত নন, তিনি কেবল ছবিওয়ালা, যা তাঁর **শিল্পীসত্তা** ও **নিরভিমান মানসিকতাকে** প্রকাশ করে।
৭. ‘সেই ছবিওয়ালার প্রতিই রাজার একটু নজর ছিল।’ — কেন ছিল বলে তোমার মনে হয়?
রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় কেবল সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন না, তিনি শিল্পেরও অনুরাগী ছিলেন। তাঁর ছবিওয়ালা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি নজর থাকার কারণ:
- **বিনয় ও সরলতা:** অবনীন্দ্রনাথের শিল্পীসুলভ বিনয়ী মনোভাব রাজার ভালো লেগেছিল।
- **শিল্পের প্রতি অনুরাগ:** রাজা জানতেন যে অবনীন্দ্রনাথ একজন বড় মাপের শিল্পী, এবং তিনি শিল্পীদের সম্মান করতেন।
- **সভায় বৈচিত্র্য:** সভার পরিবেশ কেবল গম্ভীর সাহিত্য বা পাণ্ডিত্য দিয়ে ভরে না দিয়ে, তার সঙ্গে **চিত্রকলার মতো ভিন্ন শিল্পকেও** সম্মান জানানো রাজার রুচির পরিচায়ক ছিল।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৮. ‘নাটোরের কথা’ রচনা অবলম্বনে নাটোরের সাহিত্য সভার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও এবং সেখানে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার পরিচয় দাও।
নাটোরের সাহিত্য সভার বিবরণ:
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণামূলক রচনা ‘নাটোরের কথা’-য় নাটোর রাজ্যের দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত এক **বিরাট সাহিত্য সভার** বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই সভার আয়োজন করেছিলেন সাহিত্যপ্রেমী **রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়**। এই সভাটি ছিল তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের **গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মিলনক্ষেত্র**।
- **অতিথি ও আতিথেয়তা:** এই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতো বরেণ্য সাহিত্যিক ও শিল্পীরা যোগ দিয়েছিলেন। রাজার আতিথেয়তা ছিল আন্তরিক ও রাজকীয়।
- **আলোচনার বিষয়:** সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্য ও শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা। এখানে বিভিন্ন সাহিত্যিক তাঁদের রচনা ও ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন।
- **শিল্পী হিসেবে ভূমিকা:** অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সভার ছবি আঁকেন। তিনি নিজেকে **’ছবিওয়ালা’** হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।
রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা:
এই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:
- **কেন্দ্রবিন্দু:** রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সভার প্রধান আকর্ষণ ও **কেন্দ্রবিন্দু**। তাঁর ব্যক্তিত্বের তেজ ও প্রতিভার কারণে সকলেই তাঁকে ঘিরে থাকত।
- **মনোরঞ্জন:** সভার একঘেয়েমি কাটাতে রবীন্দ্রনাথ নানা **গান** গেয়ে এবং **রসিকতা** করে পরিবেশ হালকা করতেন। তাঁর উপস্থিতি সভায় এক অন্যরকম **প্রাণ ও উদ্দীপনা** সৃষ্টি করত।
এই সভাটি কেবল একটি অনুষ্ঠান ছিল না, বরং এটি ছিল **বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক ঐতিহাসিক মিলনক্ষণ**।