বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
সপ্তম পাঠ: ভয় কি মরণে (মুকুন্দদাস) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** গান/দেশাত্মবোধক সঙ্গীত | **বিষয়বস্তু:** দেশের জন্য মৃত্যুভয় জয় করে আত্মাহুতি দেওয়ার আহ্বান।
—১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
**মুকুন্দদাস** (জন্ম: ১৮৭৮) ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের একজন **উত্তেজক বাণীবাহক** এবং সঙ্গীত রচয়িতা। তাঁর গানগুলি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দীপনা যোগাত। **’ভয় কি মরণে’** গানটি হলো সেই ধারারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এটি মূলত **মৃত্যুভয় জয় করে দেশকে মুক্ত করার জন্য আত্মাহুতি** দেওয়ার আহ্বান জানায়।
মূল বক্তব্য:
- **মৃত্যুভয় জয়:** কবি প্রশ্ন তুলেছেন, **’ভয় কি মরণে, মরণে, মরণে?’** অর্থাৎ, দেশের জন্য জীবন দিতে কি ভয়? তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, এমন মৃত্যু ভয়ের নয়, বরং **গৌরবের**।
- **দেশের ঋণ শোধ:** কবি দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, জন্মভূমির **’শত কোটি ঋণ’** শোধ করার একমাত্র পথ হলো **জীবন উৎসর্গ** করা।
- **শহিদের গৌরব:** দেশের জন্য জীবন দিলে সেই আত্মাহুতি বৃথা যায় না। **শহিদরা** মৃত্যুর পরেও অমর হয়ে থাকে এবং দেশের ইতিহাসে তাদের স্থান হয় **’সুবর্ণ অক্ষরে’**।
- **বিপ্লবের প্রেরণা:** গানটি পরাধীনতার সময় দেশের যুবকদের মধ্যে সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে অপরিহার্য ভূমিকা নিয়েছিল।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **মরণে:** মৃত্যুতে।
- **শত কোটি ঋণ:** জন্মভূমির প্রতি আমাদের অগুনতি ঋণ, যা তার আলো-বাতাস গ্রহণ করে আমরা বড় হয়েছি।
- **শোধ:** ঋণ পরিশোধ করা।
- **আত্মাহুতি:** নিজের জীবন উৎসর্গ করা।
- **ভীতু:** ভীত, কাপুরুষ।
- **সুবর্ণ অক্ষরে:** সোনার অক্ষরে। এখানে **অমর ও উজ্জ্বল** স্থান বোঝাতে ব্যবহৃত।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. কবি কোন কারণে মৃত্যুভয় না করার কথা বলেছেন?
কবি **দেশের জন্য আত্মাহুতি** দেওয়ার ক্ষেত্রে মৃত্যুভয় না করার কথা বলেছেন।
২. জন্মভূমির ঋণ শোধ করার উপায় কী?
জন্মভূমির **’শত কোটি ঋণ’** শোধ করার একমাত্র উপায় হলো **দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ** করা বা আত্মাহুতি দেওয়া।
৩. মরণে ভয় পেলে কী হতে হয়?
মরণে ভয় পেলে **’ভীতু’** বা কাপুরুষ হতে হয়।
৪. দেশের জন্য জীবনদানকারীদের স্থান কোথায় হয়?
দেশের জন্য জীবনদানকারীদের স্থান **ইতিহাসে সুবর্ণ অক্ষরে** লেখা থাকে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৫. ‘ভয় কি মরণে, মরণে, মরণে’—কবিতায় বারবার এই প্রশ্ন করার কারণ কী?
কবিতায় বারবার এই প্রশ্ন করার মূল কারণ হলো **দেশের মানুষের মনে জমে থাকা মৃত্যুভয় দূর করে বিদ্রোহের চেতনা জাগানো**।
- **আহ্বান:** পরাধীনতার সময়ে সংগ্রামীরা যাতে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করতে পারে, তার জন্য এটি একটি **আহ্বান**।
- **উদ্দীপনা:** এটি একটি **উদ্দীপক কৌশল**, যা শ্রোতাদের মনে সাহস ও বীরত্বের ভাব সৃষ্টি করে এবং তাদের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে।
- **গৌরবের প্রতিষ্ঠা:** বারবার এই প্রশ্ন করার মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, দেশের জন্য মৃত্যু কোনো ভয়ংকর বিষয় নয়, বরং **গৌরবের**।
৬. ‘শত কোটি ঋণ, শত কোটি ঋণ / শোধিতে হবে’—জন্মভূমির ঋণ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
এখানে জন্মভূমির ঋণ বলতে বোঝানো হয়েছে:
- **প্রকৃতির অবদান:** আমরা যে দেশে জন্ম নিয়েছি, তার **আলো, বাতাস, মাটি ও জল** ব্যবহার করে জীবনধারণ করি। এই প্রাকৃতিক সুবিধাগুলোই আমাদের প্রতি দেশের ঋণ।
- **দেশমাতৃকার প্রতি কর্তব্য:** যখন সেই দেশ পরাধীন বা বিপন্ন, তখন তাকে রক্ষা করার জন্য জীবন দেওয়াটাই হলো সেই **ঋণ শোধের** একমাত্র পথ।
- **আবেগিক বন্ধন:** এই ঋণ কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং **স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসার** এক গভীর বন্ধন। তাই এই ঋণ শোধ করার আহ্বান মূলত দেশের প্রতি **আত্মিক আনুগত্যের** বহিঃপ্রকাশ।
৭. দেশের জন্য আত্মাহুতি কেন অমরত্ব এনে দেয়?
দেশের জন্য আত্মাহুতি অমরত্ব এনে দেয় কারণ:
- **ইতিহাসে স্থান:** যে ব্যক্তি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে, তার নাম **ইতিহাসে সুবর্ণ অক্ষরে** লেখা থাকে।
- **অবিস্মরণীয় প্রেরণা:** সেই শহিদের ত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে **দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ** করে এবং তাদের জন্য **মুক্তির পথ** তৈরি করে দেয়।
- **শারীরিক মৃত্যু তুচ্ছ:** শহিদের শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও, তার **আদর্শ ও আত্মিক উপস্থিতি** দেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অমলিন থাকে। এইভাবেই তিনি অমরত্ব লাভ করেন।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৮. ‘ভয় কি মরণে’ গানটিতে মুকুন্দদাস কীভাবে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের উদ্দীপনা সঞ্চার করেছেন, তা আলোচনা করো।
**মুকুন্দদাসের** এই গানটি স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশবাসীর মনে **মৃত্যুভয় জয় করে আত্মত্যাগের** এক তীব্র উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল:
- **প্রশ্ন ও আহ্বান:** কবি গানে বারবার প্রশ্ন করেছেন, **’ভয় কি মরণে, মরণে, মরণে?’** এই প্রশ্নটি দেশবাসীর মনের **সুপ্ত সাহসকে জাগিয়ে** তুলেছে এবং তাদের ভয়কে তুচ্ছ করতে শিখিয়েছে।
- **ঋণ শোধের তাগিদ:** কবি দেশমাতৃকার **’শত কোটি ঋণ’**-এর কথা উল্লেখ করে সেই ঋণ শোধ করার একমাত্র উপায় হিসেবে **আত্মাহুতির** কথা বলেছেন। এটি দেশের মানুষের মনে এক গভীর **কর্তব্যের তাগিদ** তৈরি করেছে।
- **বীরত্বের প্রতিষ্ঠা:** কবি স্পষ্ট করেছেন যে দেশের জন্য জীবন দিলে তা **বীরত্ব** ও **গৌরবের** প্রতীক হয়, যা **ইতিহাসে সুবর্ণ অক্ষরে** লেখা থাকে। এর ফলে সাধারণ মানুষের কাছে মৃত্যু আর ভয়ের বিষয় থাকে না, তা **সম্মানের** প্রতীক হয়ে ওঠে।
- **সহজ ভাষা:** গানটির **সহজ, সরল ভাষা** এবং **আবেগিক আবেদন** সেই সময় সাধারণ মানুষকেও বিপ্লবের পথে সামিল হতে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এভাবে, ‘ভয় কি মরণে’ গানটি পরাধীনতার যুগে দেশের যুবকদের জন্য একটি **বিপ্লবী মন্ত্র** এবং **অমরত্বের সনদ** হিসেবে কাজ করেছিল।