বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)
সপ্তম পাঠ: স্বাধীনতা (ল্যাংস্টন হিউজ) – নোটস ও উত্তর
**উৎস:** কবিতা (অনুবাদ) | **বিষয়বস্তু:** স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, অধিকারের দাবি এবং সেই অধিকারের মূল্য নির্ধারণ।
—১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)
আমেরিকান কবি **ল্যাংস্টন হিউজ** (অনুবাদ: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও শুভ্রা ঘোষ) রচিত **’স্বাধীনতা’** কবিতাটি মূলত **অধিকারের দাবি** এবং সেই অধিকার অর্জনের জন্য **সক্রিয় অংশগ্রহণের** বার্তা বহন করে। কবি এখানে স্বাধীনতাকে একটি **’পকেটের ছোট্ট একটা পয়সা’** বা সহজে প্রাপ্য বস্তু হিসেবে না দেখে, তাকে **জীবনের মৌলিক অধিকার** এবং **কঠিন সংগ্রামের ফল** হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
মূল বক্তব্য:
- **অধিকারের সহজলভ্যতা নয়:** কবি শুরুতে ঘোষণা করেছেন যে স্বাধীনতা **’কোনোদিনও আসবে না’** যদি শুধু **’কোলাহল’-এর** মাধ্যমে তাকে ডাকা হয়। স্বাধীনতা সহজলভ্য বা এমনিতেই প্রাপ্ত হয় না।
- **মালিকানার দাবি:** স্বাধীনতা হলো **’দুর্গার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার, দুষ্প্রাপ্য জমির মালিকানা’**-র মতো, যা **সকলের মতো আপনারও অধিকার**। এই অধিকার অর্জন করতে হবে।
- **স্বেচ্ছায় গ্রহণ নয়:** স্বাধীনতা এমন কিছু নয়, যা হঠাৎ একদিন **’শুনে শুনে জ্ঞান পাবে’**। অর্থাৎ, শুধু জ্ঞান বা কথার মাধ্যমে স্বাধীনতা আসে না।
- **ত্যাগ ও সংগ্রাম:** স্বাধীনতা একটি **’পকেটস্থ বীণা’** বা অলসতার বস্তু নয়। এটি অর্জনের জন্য **বিশাল শৃঙ্খল ভাঙার** মতো কঠিন সংগ্রামের প্রয়োজন। এটি **ক্ষয়হীন আশা** এবং **মৃত্যুহীন মর্যাদার** প্রতীক।
- **ব্যক্তিগত প্রস্তুতি:** কবি পাঠককে বলছেন, স্বাধীনতা অর্জন তখনই সম্ভব, যখন তুমি **’আজিও সেথা যেখানেই রস করি, তুমি যেখানে’** অর্থাৎ, যখন ব্যক্তি মানসিকভাবে প্রস্তুত হবে এবং স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারবে।
২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা
- **কোলাহল:** চিৎকার বা গোলমাল। এখানে নিষ্ফল আন্দোলন বা অর্থহীন দাবিকে বোঝানো হয়েছে।
- **দুর্গার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার:** দুর্গম বা কঠিন কাজ বা অর্জন। স্বাধীনতা সহজে পাওয়া যায় না, তা দুর্লভ।
- **দুষ্প্রাপ্য জমির মালিকানা:** সহজে পাওয়া যায় না এমন মূল্যবান সম্পদের উপর অধিকার।
- **আভাসও হওয়া সকলের মতো:** সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
- **পকেটস্থ বীণা:** পকেটে রাখা বীণার মতো সামান্য বস্তু। অর্থাৎ, স্বাধীনতা হালকা বা তুচ্ছ বস্তু নয়।
- **বিশাল শৃঙ্খল ভাঙা:** স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বড় মাপের সংগ্রাম, ত্যাগ ও বিদ্রোহের প্রতীক।
- **বীচার জন্ম:** বিচার বিবেচনা, আলোচনা বা বিবেকের জন্ম।
৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)
(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):
১. স্বাধীনতা কখন আসবে না?
কবি বলেছেন, স্বাধীনতা **’কোনোদিনও আসবে না’** যদি কেবল **’কোলাহল’-এর** মাধ্যমে তাকে ডাকা হয়।
২. স্বাধীনতাকে কিসের মতো অধিকার বলা হয়েছে?
স্বাধীনতা হলো **দুর্গার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার** এবং **দুষ্প্রাপ্য জমির মালিকানা-র** মতো অধিকার, যা সকলের জন্য সমান।
৩. স্বাধীনতা কী হতে পারে না?
স্বাধীনতা **’পকেটের ছোট্ট একটা পয়সা’**, **’কোলাহল’** অথবা **’পকেটস্থ বীণা’** হতে পারে না।
৪. স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কী প্রয়োজন?
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য **বিশাল শৃঙ্খল ভাঙার** মতো কঠিন সংগ্রামের প্রয়োজন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):
৫. ‘আভাসও হওয়া সকলের মতো / অধিকার রয়েছে’—কবি এই পঙ্ক্তিতে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
এই পঙ্ক্তিতে কবি **স্বাধীনতার সর্বজনীনতা** এবং **মৌলিক অধিকারের** উপর জোর দিয়েছেন।
- **সার্বজনীন অধিকার:** স্বাধীনতা কেবল কিছু নির্বাচিত মানুষের জন্য নয়, এটি **সকলের** জন্য সমানভাবে প্রাপ্য।
- **অংশগ্রহণের গুরুত্ব:** অধিকারের এই ‘আভাস’ বা উপলব্ধি শুধু মুখে বললেই হয় না, বরং সেই অধিকার **প্রতিষ্ঠা** করার জন্য সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়।
- **বৈষম্যহীন সমাজ:** কবি চেয়েছেন, সমাজে কোনো বৈষম্য থাকবে না—প্রত্যেক ব্যক্তি তার ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতার অংশীদার হবে।
৬. ‘স্বাধীনতা কোনোদিনও আসবে না, / কোলাহলই নয়’—পঙ্ক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
এই উক্তিটির মাধ্যমে কবি স্বাধীনতার **অর্জনে সক্রিয়তার** গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
- **নিষ্ফল আন্দোলন:** ‘কোলাহল’ বলতে কবি **অর্থহীন চিৎকার, নিষ্ফল আলোচনা বা কেবলই মুখে দাবি** করাকে বোঝাতে চেয়েছেন।
- **কাজের গুরুত্ব:** শুধু চেঁচামেচি করে বা দাবি করে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। এর জন্য **ত্যাগ, সংগ্রাম ও সুচিন্তিত পদক্ষেপের** প্রয়োজন।
- **প্রকৃত মূল্য:** স্বাধীনতাকে যদি সহজলভ্য মনে করা হয়, তাহলে তার মূল্য থাকে না। তাই কবি মনে করেন, স্বাধীনতার জন্য যতক্ষণ না মানুষ **সংগ্রামের পথে** নামে, ততক্ষণ তা আসে না।
৭. স্বাধীনতা কেন ‘পকেটের ছোট্ট একটা পয়সা’ বা ‘পকেটস্থ বীণা’ নয়?
স্বাধীনতা **’পকেটের ছোট্ট একটা পয়সা’** বা **’পকেটস্থ বীণা’** নয়, কারণ:
- **মূল্যের ভিন্নতা:** একটি পয়সা হলো একটি **তুচ্ছ, সহজে প্রাপ্য** জিনিস। কিন্তু স্বাধীনতা হলো **জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ** ও অধিকার, যার দাম অর্থ দিয়ে মাপা যায় না।
- **প্রয়োজনীয় ত্যাগ:** বীণা বাদ্যযন্ত্র হলেও ‘পকেটস্থ বীণা’ একপ্রকার **অলস বিনোদনের** প্রতীক। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চাই **রক্তপাত, সংগ্রাম ও ত্যাগ**, অলস বিনোদন নয়।
- **গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা:** এই উপমাগুলির সাহায্যে কবি স্বাধীনতার গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এটিকে সস্তা জিনিস মনে করা উচিত নয়।
রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):
৮. ‘স্বাধীনতা’ কবিতাটিতে কবি ল্যাংস্টন হিউজ স্বাধীনতার অর্জনে যে সক্রিয় ভূমিকা ও চেতনার কথা বলেছেন, তা বিশ্লেষণ করো।
ল্যাংস্টন হিউজ তাঁর **’স্বাধীনতা’** কবিতায় স্বাধীনতাকে অলসতা বা নিষ্ক্রিয়তার ফল হিসেবে দেখেননি, বরং তাকে **সক্রিয় সংগ্রাম ও আত্মিক উপলব্ধির** মাধ্যমে অর্জনের বার্তা দিয়েছেন:
- **নিষ্ফলতার বিরোধিতা:** কবি প্রথমেই **’কোলাহল’** বা নিছক দাবি করে স্বাধীনতা চাওয়ার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে করেন, শুধু আওয়াজ তুলে নয়, **কাজের মাধ্যমে** অধিকার অর্জন করতে হয়।
- **অধিকারের দাবি:** কবি স্বাধীনতাকে **’দুষ্প্রাপ্য জমির মালিকানা’** এবং **’সকলের মতো অধিকার’** হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই অধিকার পেতে হলে মানুষকে **নিজেকে প্রস্তুত** করতে হবে এবং সেই দাবি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- **ভেতরের পরিবর্তন:** কবি চান মানুষ যেন শুধু বাইরে নয়, **ভেতরেও** স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়—যা কবিতার শেষাংশে **’আজিও সেথা যেখানেই রস করি, তুমি যেখানে’** পঙ্ক্তিতে প্রতিফলিত। অর্থাৎ, স্বাধীনতা ব্যক্তির **আশা, বুদ্ধি ও চেতনার** সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
- **সংগ্রামের আহ্বান:** **’বিশাল শৃঙ্খল ভাঙার’** মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করে কবি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, স্বাধীনতার পথ হলো **সংগ্রাম ও বিদ্রোহের** পথ। এটি সহজে লাভ করা যায় না; এর জন্য চাই **কঠোর ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ**।
এভাবে কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, স্বাধীনতা হলো একটি **গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ**, যা অর্জনের জন্য **সক্রিয় অংশগ্রহণ, ত্যাগ এবং মানবিক চেতনার** জন্ম দেওয়া আবশ্যিক।