সপ্তম পাঠ: শিকল-পরার গান (নোট)
প্রসেসিং হচ্ছে…

বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)

সপ্তম পাঠ: শিকল-পরার গান (কাজী নজরুল ইসলাম) – নোটস ও উত্তর

**উৎস:** কবিতা | **বিষয়বস্তু:** পরাধীনতার শিকলকে অলংকার জ্ঞান করে স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহের বার্তা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা।

১. কবিতা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)

কাজী নজরুল ইসলামের **’শিকল-পরার গান’** কবিতাটি হলো পরাধীন ভারতে লেখা এক **বিদ্রোহী সঙ্গীত**। যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ব্রিটিশ সরকারের হাতে বন্দি হতেন, তখন এই **শিকল** তাদের কাছে কষ্টের প্রতীক না হয়ে **গৌরবের ভূষণ** হিসেবে ধরা দিত।

মূল বক্তব্য:

  • **শিকলকে বরণ:** কবি পরাধীনতার শিকলকে **’ভয় করি না’** বা **’লজ্জা’** মনে না করে, তাকে **’ভূষণ’** (অলংকার) বা **’মাথার মুকুট’** হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। এটি বন্দিদের আত্মমর্যাদা ও সাহসের প্রতীক।
  • **বিদ্রোহের বার্তা:** কবির মতে, এই শিকল হলো **’শিকল-পূজারী’** ব্রিটিশদের জন্য উপহার। এই শিকল পরে তাঁরা **’বন্দী-মুক্তি-পাগল’** হওয়ার গান গাইবেন। এটি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহের ঘোষণা।
  • **মুক্তি ও দেশপ্রেম:** কবি বিশ্বাস করেন যে এই শিকল ভাঙার মধ্য দিয়েই দেশের **মুক্তি** আসবে। তাঁরা এই শিকল পরে যে গান গাইছেন, তা কেবল তাদের মুক্তির গান নয়, বরং **পরাধীন ভারতবর্ষের** মুক্তির গান।
  • **আত্মিক স্বাধীনতা:** বন্দিরা মনে করেন, তাদের হাতে শিকল পরালেও তাদের **মন ও কণ্ঠে** স্বাধীনতার আগুন জ্বলছে, যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা

  • **শিকল:** লৌহশৃঙ্খল, বন্ধন। এখানে পরাধীনতা বা কারাগারের প্রতীক।
  • **ভূষণ:** অলংকার, গয়না। কবি শিকলকে অলংকাররূপে বরণ করেছেন।
  • **শিকল-পূজারী:** ব্রিটিশ শাসক, যারা বন্দিদের শিকল পরিয়ে পরাধীনতার পূজা করত।
  • **পাগল:** এখানে দেশপ্রেমের জন্য উদগ্রীব বা উন্মত্ত অর্থে ব্যবহৃত।
  • **বেড়ি:** পায়ে পরার শিকল।
  • **মুকুট:** রাজকীয় শিরোভূষণ, এখানে সম্মানের প্রতীক।
  • **উহার:** সেটির (এখানে শিকলকে বোঝানো হয়েছে)।

৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)

(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):

১. কবি পরাধীনতার শিকলকে কী বলে বরণ করতে চেয়েছেন? [১ নম্বর]

কবি পরাধীনতার শিকলকে **’ভূষণ’** (অলংকার) এবং **’মাথার মুকুট’** বলে বরণ করতে চেয়েছেন।

২. বন্দিরা কেমন গান গাইবেন? [২ নম্বর]

বন্দিরা **’বন্দী-মুক্তি-পাগল’** হওয়ার গান গাইবেন, অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে যাওয়ার গান গাইবেন।

৩. কবি কাদের ‘শিকল-পূজারী’ বলেছেন? [১ নম্বর]

কবি **ব্রিটিশ শাসকদের** ‘শিকল-পূজারী’ বলেছেন, কারণ তারা বন্দিদের শিকল পরিয়ে পরাধীনতার শাসন টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।

৪. বন্দিদের চোখে শিকল কীসের প্রতীক? [২ নম্বর]

বন্দিদের চোখে শিকল **পরাধীনতা বা কষ্টের** প্রতীক নয়, বরং **আত্মমর্যাদা ও বিদ্রোহের** প্রতীক, যা দেশকে মুক্ত করার জন্য বরণ করা হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):

৫. ‘শিকল-পূজারীর দিতে এই শিকল, – তাদের এ ভূষণ।’—বক্তব্যটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। [৩ নম্বর]

তাৎপর্য: এই উক্তিটি একটি **বিদ্রূপাত্মক ও বিদ্রোহমূলক** মন্তব্য।

  • **শিকল-পূজারী:** ব্রিটিশরা নিজেদের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার জন্য বন্দিদের শিকল পরাত। কবি এই শিকলকে ব্রিটিশদের **’পূজার উপকরণ’** হিসেবে বিদ্রূপ করেছেন।
  • **ভূষণ:** বন্দিরা এই শিকলকে **লজ্জা বা কষ্ট** না মনে করে, বরং **দেশপ্রেম ও ত্যাগের অলংকার** হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই অলংকার যেন ব্রিটিশদের কাছে একটি বার্তা পাঠায় যে তাদের জবরদস্তি বন্দিদের মনে কোনো ভয় সৃষ্টি করতে পারেনি।

৬. ‘ওদের সাথে গাইব গান, বন্দী-মুক্তি-পাগল হবার’—বন্দিরা কেন এমন গান গাইবেন? [৩ নম্বর]

বন্দিরা এই গান গাইবেন কারণ:

  • **বিদ্রোহের উন্মাদনা:** এই গান হলো **স্বাধীনতার জন্য আত্ম-উৎসর্গ** এবং **বিদ্রোহের আগুন** মনে ধারণের প্রতীক। এই গান তাদের মধ্যে মুক্তির জন্য উন্মাদনা তৈরি করবে।
  • **শৃঙ্খল ভাঙার অঙ্গীকার:** তারা দেখাতে চেয়েছেন, শিকল তাদের আটকে রাখতে পারেনি; বরং এই শিকল পরে তারা এমন গান গাইছেন, যা **দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে** এবং অবশেষে শৃঙ্খল ভেঙে দেবে।
  • **গৌরবের প্রকাশ:** বন্দিদশা তাদের কাছে লজ্জার নয়, বরং দেশের জন্য কষ্টের প্রতীক—যা গৌরবের।

৭. পরাধীনতার বেড়ি কীভাবে শিল্পীর কণ্ঠে ‘শিকল-পরার গান’ হয়ে উঠেছে? [৩ নম্বর]

সাধারণত শিকল পরাধীনতা ও যন্ত্রণার প্রতীক। কিন্তু নজরুলের মতো শিল্পী একে **বিদ্রোহের মন্ত্রে** রূপান্তরিত করেছেন। পরাধীনতার বেড়ি যখন শিল্পীর হাতে আসে, তখন তা কেবল ধাতব শৃঙ্খল থাকে না, তা হয়ে ওঠে **দেশপ্রেমের যন্ত্র**। শিল্পী সেই শিকলের শব্দকেই ছন্দে পরিণত করে এমন গান বাঁধেন, যা সকল বন্দির মনে **মুক্তির আকাঙ্ক্ষা** এবং **আত্মমর্যাদার** জন্ম দেয়। ফলে পরাধীনতার বেড়িই বন্দি-মুক্তির গান গাওয়ার জন্য **অলংকারের** রূপ ধারণ করে।

রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):

৮. ‘শিকল-পরার গান’ কবিতাটিতে কাজী নজরুল ইসলামের যে বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়, তা বিশ্লেষণ করো। [৫ নম্বর]

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন **’বিদ্রোহী কবি’**, এবং এই কবিতায় তাঁর সেই বিদ্রোহী সত্তা স্পষ্ট:

  1. **শৃঙ্খলকে চ্যালেঞ্জ:** নজরুল পরাধীনতার প্রতীক **শিকলকে** ভয় না পেয়ে, তাকে **’ভূষণ’** ও **’মুকুট’** বলে বরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই ঔদ্ধত্য ব্রিটিশ শাসনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
  2. **বিদ্রূপ ও বিদ্রোহ:** তিনি ব্রিটিশদের **’শিকল-পূজারী’** বলে বিদ্রূপ করেছেন এবং তাদের দেওয়া শিকলকেই তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের হাতিয়ার করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, **শারীরিক বন্দিদশা** সত্ত্বেও তাঁর **মানসিক স্বাধীনতা** কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।
  3. **মুক্তির গান:** তিনি বন্দিদের নিয়ে যে গান গাওয়ার কথা বলেছেন, তা কেবল সাধারণ গান নয়, তা হলো **’বন্দী-মুক্তি-পাগল’** হওয়ার গান। এই গানে রয়েছে পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য **উন্মাদনা ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা**।
  4. **জাতীয়তাবাদের প্রচার:** কবি এই গানকে বন্দি জীবনের গণ্ডির মধ্যে আটকে না রেখে, তাকে **সমগ্র দেশের মুক্তির প্রতীক** হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর গান দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা যুগিয়েছে এবং ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

এইভাবে, ‘শিকল-পরার গান’ কবিতায় নজরুল তাঁর **অগ্নিময় ভাষা ও দৃপ্ত ভাবনার** মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খলকে **বিদ্রোহের বাদ্যযন্ত্রে** পরিণত করেছেন, যা তাঁর বিদ্রোহী সত্তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu