সপ্তম পাঠ: জেলখানার চিঠি (নোট)
প্রসেসিং হচ্ছে…

বাংলা সাহিত্য (অষ্টম শ্রেণি)

সপ্তম পাঠ: জেলখানার চিঠি (সুভাষচন্দ্র বসু) – নোটস ও উত্তর

**উৎস:** পত্র সাহিত্য | **বিষয়বস্তু:** মান্দালয় জেল থেকে দিলীপ কুমার রায়কে লেখা চিঠি, বন্দিজীবনেও আত্মিক ও মানসিক স্বাধীনতার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা।

১. রচনা পরিচিতি ও সারমর্ম (Core Theme)

সুভাষচন্দ্র বসুর লেখা **’জেলখানার চিঠি’** হলো এক অসাধারণ পত্র সাহিত্য। এটি ১৯২৪ সালের ২৪ অক্টোবর মান্দালয় জেল থেকে সঙ্গীতশিল্পী ও আধ্যাত্মিক সাধক **দিলীপ কুমার রায়কে** উদ্দেশ্য করে লেখা। এই চিঠিতে পরাধীন দেশের একজন মহান নেতার **মানসিক শক্তি, জীবনবোধ ও গভীর দার্শনিক চিন্তা** প্রতিফলিত হয়েছে।

মূল বক্তব্য:

  • **বন্দিজীবনের কষ্ট:** সুভাষচন্দ্র জানিয়েছেন যে তাঁর চিঠি ব্রিটিশদের দ্বারা **’সেন্সর’** হওয়ার কারণে তাকে **’double distillation’**-এর মতো ছেঁকে লিখতে হয়। তিনি জেলের কঠিন পরিবেশ ও অবিশ্রান্ত মানসিক চাপ সত্ত্বেও নিজের মানসিকতাকে দৃঢ় রাখার কথা বলেছেন।
  • **ভেতরের স্বাধীনতা:** লেখকের মূল বক্তব্য হলো, **’বাহিরের জবরদস্তি ভিতরের স্বাধীনতা কাড়িতে পারে না’**। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত স্বাধীনতা থাকে মানুষের মনে, যা কোনো বাইরের শক্তি বা কারাগারের চার দেওয়াল কেড়ে নিতে পারে না।
  • **আত্মিক শৃঙ্খলা:** তিনি দিলীপ কুমার রায়কে জানিয়েছেন যে জেলের একঘেয়েমি দূর করতে তিনি **ধ্যান, জপ, গান ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন** পালন করেন। তিনি আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন।
  • **জীবনের লক্ষ্য:** সুভাষচন্দ্রের মতে, জীবনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত **’সত্য লাভ করা’** এবং দেশের জন্য **’সর্বস্বান্ত’** হতে প্রস্তুত থাকা। তিনি নিজেকে **’Indian pilgrim’** (ভারতীয় তীর্থযাত্রী) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
  • **Martyrdom ও Humour:** তিনি ‘Martyrdom’ (শহিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা)-কে যেমন সম্মান করেছেন, তেমনি জীবনকে সহজ করার জন্য **’sense of humour’** (রসবোধ) ও **’sense of proportion’** (আনুপাতিক জ্ঞান)-এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

২. গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও ব্যাখ্যা

  • **সেন্সর (Censor):** সরকারি কর্মচারী, যিনি চিঠিপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনার বিষয়বস্তু পরীক্ষা করে আপত্তিজনক অংশ কেটে বাদ দেন।
  • **double distillation:** কোনো তরলকে দুইবার শোধন বা পাতন করা। এখানে চিঠির বক্তব্যকে দুইবার ছেঁকে বের করার অর্থে ব্যবহৃত।
  • **জবরদস্তি:** বলপ্রয়োগ, জোরজুলুম।
  • **আবিষ্কারের আনন্দ:** কোনো কিছু নতুন করে জানার বা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ।
  • **Indian Pilgrim:** সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এখানে তিনি নিজেকে **ভারতীয় তীর্থযাত্রী** হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যিনি এক কঠিন পথ পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে চান।
  • **Martyrdom:** দেশের জন্য বা কোনো আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গ করা, শহিদ হওয়া।
  • **sense of humour:** রসবোধ, যা জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও হাসিখুশি থাকতে সাহায্য করে।
  • **সর্বস্বান্ত:** সবকিছু ত্যাগ করা বা হারানো।

৩. হাতেকলমে (অনুশীলনী প্রশ্ন ও উত্তর)

(অনুশীলনী থেকে নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:)

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ১-২ নম্বর):

১. সুভাষচন্দ্র বসু কাকে এই চিঠিটি লিখেছিলেন? [১ নম্বর]

সুভাষচন্দ্র বসু এই চিঠিটি তাঁর বন্ধু, বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও আধ্যাত্মিক সাধক **দিলীপ কুমার রায়কে** লিখেছিলেন।

২. চিঠিটি কোথা থেকে এবং কবে লেখা হয়েছিল? [২ নম্বর]

চিঠিটি **মান্দালয় জেল** থেকে **১৯২৪ সালের ২৪ অক্টোবর** লেখা হয়েছিল।

৩. সুভাষচন্দ্র কেন তাঁর চিঠির বক্তব্যকে ‘double distillation’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন? [২ নম্বর]

ব্রিটিশ সরকার জেলের বন্দিদের চিঠিপত্র কঠোরভাবে **সেন্সর (Censor)** করত। ফলে সুভাষচন্দ্রকে তাঁর মনের কথাগুলি সেন্সরের হাত থেকে বাঁচিয়ে লেখার জন্য **ছেঁকে বা শোধন করে** লিখতে হচ্ছিল। এই কারণে তিনি তাঁর চিঠিকে ‘double distillation’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

৪. বন্দিজীবনের একঘেয়েমি কাটাতে তিনি কী কী করতেন? [২ নম্বর]

বন্দিজীবনের একঘেয়েমি কাটাতে তিনি **ধ্যান, জপ, গান গাওয়া, শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে জীবনযাপন** এবং **বইপত্র পড়া** ইত্যাদি করতেন।

সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (মান: ৩ নম্বর):

৫. ‘জেলখানার চিঠি’তে লেখক ‘sense of humour’-এর গুরুত্ব কেন তুলে ধরেছেন? [৩ নম্বর]

সুভাষচন্দ্র বসুর মতে, **রসবোধ (sense of humour)** হলো জীবনের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।

  • **মানসিক শান্তি:** জেলের মতো কঠিন, একঘেয়ে ও চাপযুক্ত পরিবেশে রসবোধ মানুষকে **মানসিকভাবে সতেজ** রাখে এবং সহজে ভেঙে পড়তে দেয় না।
  • **আনুপাতিক জ্ঞান:** রসবোধের সঙ্গে **আনুপাতিক জ্ঞান (sense of proportion)** থাকলে মানুষ জীবনের কোনো ঘটনাকে তার আসল গুরুত্বের চেয়ে বেশি বড় করে দেখে না।
এই কারণে, রসবোধ ও আনুপাতিক জ্ঞান জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৬. ‘বাহিরের জবরদস্তি ভিতরের স্বাধীনতা কাড়িতে পারে না’—ব্যাখ্যা করো। [৩ নম্বর]

এই উক্তিটি সুভাষচন্দ্র বসুর **গভীর জীবনবোধ ও দার্শনিক চিন্তার** প্রকাশ। এখানে **’বাহিরের জবরদস্তি’** বলতে কারাগারের কঠোর পরিবেশ, ব্রিটিশদের অত্যাচার ও দৈহিক বন্দিদশাকে বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে, **’ভিতরের স্বাধীনতা’** হলো মানুষের **আত্মিক ও মানসিক মুক্তি**।

সুভাষচন্দ্রের মতে, যদিও শরীরকে শিকল দিয়ে বাঁধা যায়, কিন্তু মানুষের **মন, চিন্তা, বিশ্বাস ও আদর্শকে** কোনো দেওয়াল বা শক্তি দিয়ে দমন করা সম্ভব নয়। প্রকৃত স্বাধীনতা মানুষের অন্তরে থাকে, যা কোনোভাবেই বাইরের বলপ্রয়োগে কেড়ে নেওয়া যায় না।

৭. সুভাষচন্দ্র বসু কেন নিজেকে ‘Indian pilgrim’ বা ‘ভারতীয় তীর্থযাত্রী’ বলেছেন? [৩ নম্বর]

সুভাষচন্দ্র বসু নিজেকে ‘Indian pilgrim’ বলেছেন কারণ:

  • **জীবনের লক্ষ্য:** একজন তীর্থযাত্রীর মতো তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল **পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা লাভ**। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য তিনি জেল, নির্বাসন ও আত্মত্যাগের মতো কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন।
  • **কষ্ট স্বীকার:** তীর্থযাত্রীরা যেমন কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছায়, তেমনি সুভাষচন্দ্রও দেশের মুক্তির জন্য **সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে** সংগ্রাম করেছেন।
  • **আত্মিক দৃঢ়তা:** এই উপমাটি তাঁর **মানসিক ও আত্মিক দৃঢ়তা এবং ঐকান্তিক দেশপ্রেমকে** প্রকাশ করে। তাঁর কাছে রাজনীতি ছিল এক প্রকার পবিত্র সাধনা বা তীর্থযাত্রা।

রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর (মান: ৫ নম্বর):

৮. ‘জেলখানার চিঠি’ অবলম্বনে সুভাষচন্দ্র বসুর মানসিকতা ও জীবনবোধের পরিচয় দাও। [৫ নম্বর]

সুভাষচন্দ্র বসুর ‘জেলখানার চিঠি’ তাঁর **অসাধারণ মানসিক দৃঢ়তা, গভীর জীবনবোধ ও দার্শনিক চিন্তার** পরিচয় বহন করে:

  1. **ভেতরের শক্তি:** তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে **বাহিরের জবরদস্তি ভিতরের স্বাধীনতা কাড়িতে পারে না**। তিনি কারাবাসের কষ্টকে অগ্রাহ্য করে মানসিক শক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করেন।
  2. **শৃঙ্খলা ও সাধনা:** জেলের একঘেয়েমি কাটাতে তিনি **ধ্যান, জপ, গান** ও **শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন** বেছে নেন। এটি প্রমাণ করে, তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সাধনা হিসেবে দেখতেন।
  3. **Martyrdom ও রসবোধ:** তিনি একদিকে যেমন দেশের জন্য **শহিদ হওয়ার (Martyrdom) আকাঙ্ক্ষা** পোষণ করতেন, তেমনি অন্যদিকে জীবনের কঠিন সত্যগুলিকে সহজভাবে গ্রহণ করার জন্য **রসবোধ (sense of humour)** ও **আনুপাতিক জ্ঞানের (sense of proportion)** গুরুত্ব দেন।
  4. **জীবনের লক্ষ্য:** তাঁর মতে, মানুষের প্রধান কর্তব্য হলো **সত্য লাভ করা** এবং দেশের জন্য **সর্বস্বান্ত** হতে প্রস্তুত থাকা। তিনি নিজেকে **’Indian pilgrim’** (ভারতীয় তীর্থযাত্রী) বলে দেশের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেন।

এইভাবে, সুভাষচন্দ্র বসু এই চিঠিতে একজন **দেশনেতার চেয়েও একজন দার্শনিকের** মতো নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করেছেন, যা পাঠককে কঠিন পরিস্থিতিতেও মানসিক শক্তি যোগাতে অনুপ্রাণিত করে।

BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu
BISWAZ GROWTH ACADEMY - Class Menu