বিষয়: মৌল, যৌগ ও রাসায়নিক বিক্রিয়া
অধ্যায় ২.৩: রাসায়নিক বিক্রিয়া (নোটস)
১. ভৌত পরিবর্তন (Physical Change) কাকে বলে?
যে পরিবর্তনে পদার্থের মূল রাসায়নিক গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না, শুধুমাত্র বাহ্যিক অবস্থার (যেমন – কঠিন, তরল, গ্যাস) বা আকৃতির পরিবর্তন হয়, তাকে ভৌত পরিবর্তন বলে। এই পরিবর্তনে সাধারণত নতুন কোনো পদার্থ উৎপন্ন হয় না।
উদাহরণ: জল জমে বরফ হওয়া, বাষ্পীভূত হয়ে জলীয় বাষ্প হওয়া, চিনির জলীয় দ্রবণ তৈরি, কাচ ভেঙে যাওয়া।
২. রাসায়নিক পরিবর্তন (Chemical Change) কাকে বলে?
যে পরিবর্তনে এক বা একাধিক পদার্থ পরিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধর্মবিশিষ্ট এক বা একাধিক পদার্থে পরিণত হয়, তাকে রাসায়নিক পরিবর্তন বা রাসায়নিক বিক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: লোহায় মরচে পড়া, দুধ থেকে দই হওয়া, চাল ফুটে ভাত হওয়া, ম্যাগনেসিয়াম ফিতা জ্বলে ওঠা।
৩. রাসায়নিক সমীকরণ (Chemical Equation) কী?
চিহ্ন ও সংকেতের সাহায্যে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সংক্ষেপে প্রকাশ করার পদ্ধতিকে রাসায়নিক সমীকরণ বলে।
উদাহরণ: $C + O_2 \rightarrow CO_2$ (কার্বন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়)।
৪. বিক্রিয়ক (Reactant) ও বিক্রিয়াজাত পদার্থ (Product) কাকে বলে?
- বিক্রিয়ক: রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে পদার্থ বা পদার্থগুলি অংশগ্রহণ করে, তাদের বিক্রিয়ক বলে। (সমীকরণের বাঁ দিকে লেখা হয়)।
- বিক্রিয়াজাত পদার্থ: রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে যে নতুন ধর্মবিশিষ্ট পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাদের বিক্রিয়াজাত পদার্থ বলে। (সমীকরণের ডান দিকে লেখা হয়)।
৫. প্রত্যক্ষ সংযোগ বিক্রিয়া (Direct Combination Reaction) কী?
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দুই বা ততোধিক মৌল বা যৌগ সরাসরি যুক্ত হয়ে একটি নতুন যৌগ গঠন করে, তাকে প্রত্যক্ষ সংযোগ বিক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: $C + O_2 \rightarrow CO_2$ (কার্বন ও অক্সিজেন যুক্ত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড)।
৬. বিয়োজন বিক্রিয়া (Decomposition Reaction) কী?
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটি যৌগ ভেঙে গিয়ে দুই বা ততোধিক সরল মৌল বা যৌগ উৎপন্ন করে, তাকে বিয়োজন বিক্রিয়া বলে। এই বিক্রিয়া সাধারণত তাপ বা তড়িৎ শক্তির প্রভাবে ঘটে।
উদাহরণ: $CaCO_3 \xrightarrow{\text{তাপ}} CaO + CO_2$ (চুনাপাথর ভেঙে পোড়াচুন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড)।
চিত্র: (বাম) সংযোগ বিক্রিয়া (A+B → AB) এবং (ডান) বিয়োজন বিক্রিয়া (AB → A+B)।
৭. প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া (Substitution Reaction) কী?
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনো যৌগ থেকে একটি মৌলকে সরিয়ে সেই জায়গায় অন্য একটি মৌল (সাধারণত বেশি সক্রিয়) প্রতিস্থাপিত হয়, তাকে প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: $Zn + CuSO_4 \rightarrow ZnSO_4 + Cu$ (জিঙ্ক, কপার সালফেট থেকে কপারকে প্রতিস্থাপিত করে)।
৮. বিনিময় বিক্রিয়া (Exchange Reaction) কী?
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দুটি যৌগিক পদার্থ তাদের উপাদানমূলক বা আয়নসমূহ পরস্পর বিনিময় করে নতুন যৌগ গঠন করে, তাকে বিনিময় বিক্রিয়া বলে।
উদাহরণ: $AgNO_3 + NaCl \rightarrow AgCl \downarrow + NaNO_3$ (সিলভার নাইট্রেট ও সোডিয়াম ক্লোরাইড বিক্রিয়া করে সিলভার ক্লোরাইডের সাদা অধঃক্ষেপ ফেলে)।
৯. দহন (Combustion) কী?
দহন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া যাতে কোনো পদার্থ অক্সিজেনের সঙ্গে তীব্রভাবে বিক্রিয়া করে তাপ ও আলো উৎপন্ন করে। এটি একটি জারণ বিক্রিয়া।
উদাহরণ: মিথেনের দহন: $CH_4 + 2O_2 \rightarrow CO_2 + 2H_2O + \text{তাপ ও আলো}$
১০. অনুঘটক (Catalyst) কাকে বলে?
যে রাসায়নিক পদার্থ কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উপস্থিত থেকে বিক্রিয়ার গতিবেগ বাড়ায় বা কমায়, কিন্তু বিক্রিয়ার শেষে নিজে অপরিবর্তিত থাকে, তাকে অনুঘটক বলে।
উদাহরণ: হাইড্রোজেন পারক্সাইড ($H_2O_2$) ভেঙে $O_2$ উৎপাদনের সময় ম্যাঙ্গানিজ ডাইঅক্সাইড ($MnO_2$) অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। $2H_2O_2 \xrightarrow{MnO_2} 2H_2O + O_2$
১১. ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অনুঘটক কী?
- ধনাত্মক অনুঘটক (Positive Catalyst): যে অনুঘটক বিক্রিয়ার গতিবেগ বাড়ায় (যেমন, $MnO_2$)।
- ঋণাত্মক অনুঘটক (Negative Catalyst): যে অনুঘটক বিক্রিয়ার গতিবেগ কমিয়ে দেয় (যেমন, $H_2O_2$-এর বিয়োজনে গ্লিসারিন)।
১২. নির্দেশক (Indicator) কাকে বলে?
যেসব পদার্থ নিজেদের বর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো দ্রবণ আম্লিক (অ্যাসিড), ক্ষারকীয় (বেস) না প্রশম (নিউট্রাল) তা নির্দেশ করে, তাদের নির্দেশক বলে।
উদাহরণ: লিটমাস, মিথাইল অরেঞ্জ, ফেনলফথ্যালিন, হলুদের রস, জবা ফুলের রস।
১৩. অ্যাসিড, ক্ষার ও প্রশম দ্রবণে লিটমাসের বর্ণ কী হয়?
- অ্যাসিড দ্রবণ: নীল লিটমাসকে লাল করে।
- ক্ষারকীয় দ্রবণ: লাল লিটমাসকে নীল করে।
- প্রশম দ্রবণ: লিটমাসের বর্ণের কোনো পরিবর্তন করে না।
চিত্র: অ্যাসিড নীল লিটমাসকে লাল করে এবং ক্ষার লাল লিটমাসকে নীল করে।
১৪. দুটি প্রাকৃতিক নির্দেশকের নাম লেখো।
হলুদের রস এবং জবা ফুলের রস।
হলুদ: ক্ষারকীয় দ্রবণে লালচে-বাদামি বর্ণ ধারণ করে।
জবা ফুলের রস: অ্যাসিড দ্রবণে লাল এবং ক্ষারকীয় দ্রবণে সবুজ বর্ণ ধারণ করে।
১৫. অ্যাসিড (Acid) কাকে বলে?
সাধারণত যেসব যৌগ জলীয় দ্রবণে বিয়োজিত হয়ে হাইড্রোজেন আয়ন ($H^+$) উৎপন্ন করে এবং টক স্বাদযুক্ত হয় ও নীল লিটমাসকে লাল করে, তাদের অ্যাসিড বলে।
উদাহরণ: হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ($HCl$), সালফিউরিক অ্যাসিড ($H_2SO_4$)।
১৬. ক্ষারক (Base) কাকে বলে?
সাধারণত যেসব যৌগ জলীয় দ্রবণে বিয়োজিত হয়ে হাইড্রক্সাইড আয়ন ($OH^-$) উৎপন্ন করে এবং কষা স্বাদযুক্ত হয় ও লাল লিটমাসকে নীল করে, তাদের ক্ষারক বলে।
উদাহরণ: সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ($NaOH$), ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড ($Ca(OH)_2$)।
১৭. প্রশমন বিক্রিয়া (Neutralization Reaction) কাকে বলে?
যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অ্যাসিড ও ক্ষারক পরস্পর বিক্রিয়া করে লবণ ও জল উৎপন্ন করে এবং অ্যাসিড ও ক্ষার উভয়েই তাদের নিজস্ব ধর্ম হারায়, তাকে প্রশমন বিক্রিয়া বলে।
সমীকরণ: অ্যাসিড + ক্ষারক $\rightarrow$ লবণ + জল
উদাহরণ: $HCl + NaOH \rightarrow NaCl + H_2O$
১৮. লবণ (Salt) কাকে বলে?
প্রশমন বিক্রিয়ায় অ্যাসিড ও ক্ষারকের বিক্রিয়ার ফলে যে আয়নীয় যৌগটি উৎপন্ন হয়, তাকে লবণ বলে। অথবা, অ্যাসিডের $H^+$ আয়নকে ধাতু বা ধাতুর মতো মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করলে যে যৌগ পাওয়া যায়, তাকে লবণ বলে।
উদাহরণ: সোডিয়াম ক্লোরাইড ($NaCl$), কপার সালফেট ($CuSO_4$)।