ভূমিকা: শব্দের কারিগর
আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি স্বরধ্বনি হলো শব্দের 'প্রাণ'। কিন্তু শুধু প্রাণ থাকলেই তো হবে না, একটা শরীরও তো চাই, তাই না? এই শরীরটাই গড়ে তোলে ব্যঞ্জনধ্বনি। ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো হলো দক্ষ কারিগরের মতো, যারা স্বরধ্বনির সাহায্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর শব্দ তৈরি করে। 'মা' শব্দটি বলতে গেলে 'ম' ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে 'আ' স্বরধ্বনিকে জুড়তে হয়। 'ম' ছাড়া যেমন 'মা' হয় না, তেমনই 'আ' ছাড়াও 'ম'-এর উচ্চারণ স্পষ্ট হয় না।
ব্যঞ্জনধ্বনি একা একা চলতে পারে না, তার সবসময় একজন স্বরধ্বনি বন্ধুকে পাশে লাগে। এরা দুজন মিলেই একটি সম্পূর্ণ অক্ষর তৈরি করে। আজ আমরা বাংলা ভাষার এই কারিগর, অর্থাৎ ব্যঞ্জনধ্বনিদের জগৎ ঘুরে দেখব। জানব, তাদের কত রকমফের আর তারা কীভাবে আমাদের মুখের কথায় এত বৈচিত্র্য নিয়ে আসে।
সারাংশ
যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস থেকে আসা বাতাস মুখের মধ্যে কোনো না কোনো জায়গায় (যেমন: কণ্ঠ, তালু, দাঁত, ঠোঁট) বাধা পায় এবং যা স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হতে পারে না, তাদের ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। বাংলা ভাষায় মোট ৩৯টি ব্যঞ্জনধ্বনি আছে। উচ্চারণের স্থান এবং বাতাসের চাপের উপর ভিত্তি করে এদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন - স্পর্শধ্বনি, নাসিক্য ধ্বনি, উষ্মধ্বনি ইত্যাদি।
ব্যঞ্জনধ্বনিদের চিনে নিই
বাংলা ভাষার ৩৯ জন 'কারিগর' বা ব্যঞ্জনধ্বনি হলো:
ক খ গ ঘ ঙ
চ ছ জ ঝ ঞ
ট ঠ ড ঢ ণ
ত থ দ ধ ন
প ফ ব ভ ম
য র ল ব
শ ষ স হ
ড় ঢ় য় ৎ ং ঃ ঁ
ব্যঞ্জনধ্বনির প্রকারভেদ
ব্যঞ্জনধ্বনিদের উচ্চারণের ধরণ অনুযায়ী কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়:
১. স্পর্শধ্বনি (ক থেকে ম পর্যন্ত):
এই ২৫টি ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ বা ঠোঁট মুখের কোনো না কোনো অংশকে স্পর্শ করে। উচ্চারণের স্থান অনুযায়ী এদের ৫টি দলে বা বর্গে ভাগ করা হয়:
- ক-বর্গ (কণ্ঠ্য): ক, খ, গ, ঘ, ঙ (উচ্চারণ হয় কণ্ঠ থেকে)
- চ-বর্গ (তালব্য): চ, ছ, জ, ঝ, ঞ (উচ্চারণ হয় তালু থেকে)
- ট-বর্গ (মূর্ধন্য): ট, ঠ, ড, ঢ, ণ (উচ্চারণ হয় মূর্ধা থেকে)
- ত-বর্গ (দন্ত্য): ত, থ, দ, ধ, ন (উচ্চারণ হয় দাঁত থেকে)
- প-বর্গ (ওষ্ঠ্য): প, ফ, ব, ভ, ম (উচ্চারণ হয় ঠোঁট থেকে)
চিত্র: স্পর্শধ্বনির পাঁচটি বর্গ
২. অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনি:
- অল্পপ্রাণ: বর্গের ১ম ও ৩য় ধ্বনি (ক, গ, চ, জ ইত্যাদি) উচ্চারণে নিঃশ্বাস জোরে বের হয় না।
- মহাপ্রাণ: বর্গের ২য় ও ৪র্থ ধ্বনি (খ, ঘ, ছ, ঝ ইত্যাদি) উচ্চারণে নিঃশ্বাস জোরে বের হয় এবং 'হ'-এর মতো একটা শব্দ শোনা যায়।
৩. অঘোষ ও ঘোষ ধ্বনি:
- অঘোষ: বর্গের ১ম ও ২য় ধ্বনি (ক, খ, চ, ছ ইত্যাদি) উচ্চারণে স্বরতন্ত্রী কাঁপে না।
- ঘোষ: বর্গের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ধ্বনি (গ, ঘ, ঙ, জ, ঝ, ঞ ইত্যাদি) উচ্চারণে স্বরতন্ত্রী কাঁপে।
৪. অন্যান্য প্রকার:
- নাসিক্য ধ্বনি: ঙ, ঞ, ণ, ন, ম (উচ্চারণে বাতাস নাক দিয়ে বের হয়)।
- অন্তঃস্থ ধ্বনি: য, র, ল, ব (স্পর্শ ও উষ্মধ্বনির মাঝে এদের স্থান)।
- উষ্মধ্বনি: শ, ষ, স, হ (উচ্চারণে নিঃশ্বাস দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখা যায়)।
হাতে কলমে (উত্তরসহ)
১. ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে?
উত্তর: যে ধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে পারে না এবং উচ্চারণের সময় মুখের মধ্যে বাতাস বাধা পায়, তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন: ক, চ, প ইত্যাদি।
২. স্পর্শধ্বনি কয়টি? 'ত' বর্গকে দন্ত্যধ্বনি বলা হয় কেন?
উত্তর: স্পর্শধ্বনি মোট ২৫টি (ক থেকে ম পর্যন্ত)। 'ত' বর্গের ধ্বনিগুলো (ত, থ, দ, ধ, ন) উচ্চারণের সময় জিভের ডগা উপরের পাটির দাঁতকে স্পর্শ করে, তাই এদের দন্ত্যধ্বনি বলা হয়।
৩. অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনির পার্থক্য কী? একটি করে উদাহরণ দাও।
উত্তর: যে ধ্বনি উচ্চারণে নিঃশ্বাস বায়ু কম পরিমাণে বের হয় তা অল্পপ্রাণ, আর যে ধ্বনি উচ্চারণে নিঃশ্বাস বায়ু বেশি পরিমাণে বের হয় তা মহাপ্রাণ। যেমন: 'গ' একটি অল্পপ্রাণ ধ্বনি, কিন্তু 'ঘ' একটি মহাপ্রাণ ধ্বনি।
অধ্যায়ের কুইজ
এই অধ্যায়ে তুমি কতটা শিখলে, তা পরীক্ষা করার জন্য প্রস্তুত?
মোট ৩০টি প্রশ্ন আছে। প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য ১ নম্বর পাবে।